ডঃ পি সি সরকার : ( জুনিয়র) বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী ও বিশিষ্ট লেখক। কলকাতা, ৮, ডিসেম্বর, ২০২০। আমি বাঙাল। হিন্দু বাঙাল। হিন্দু হওয়ার অপরাধে, ভিটা -মাটি ছেড়ে দিশেহারা, সর্বস্বহারা, আত্মীয়-সম নিকট বন্ধুদেরকে বিশ্বাস করে ঠকা, খাঁটি বাঙাল। শুধু আমি নই, আমাদের বাড়ির সব্বাই বাঙাল। আমি নিজের জন্মভিটাকে, ওদের মতো 'সম্পত্তি' বা 'জমি' না ভেবে, 'মা' বলে ভাবার বা ডাকায় বিশ্বাসী স্বাধীন বাঙাল। এতদিনের চেনাজানা আপন মানুষ জনের কাছে তাড়া খাওয়া, অপমানিত বাঙাল…..তবে এখন পাল্টে গেছি, এখন এক বুক ভর্তি গর্ব, চেতনা, স্বপ্ন এবং আত্মবিশ্বাস- ভরা খাঁটী ভারতীয় হিন্দু বাঙাল। যখন এপারে চলে আসি, তখন আমি ছিলাম আমার মায়ের কোলে, নবজাত শিশু। গণ্ডীর দাগ কাটার বা ঘণ্টা বাজার একটু আগে এপারে আসতে পেরেছি।

সারমেয়রা যেমন মূত্রগণ্ডির সীমানার বাইরে পায়তাড়া করে না। অন্য জন্তুরা 'সেফ্', নিশ্চিন্ত হয়ে থাকে। ঠিক সেই নিশ্চিন্তিতে আমি চোখ বন্ধ করে দু-হাত কষে মুঠো করে, দুলালের পাশে রেখে, মায়ের কোলে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখায় ব্যস্ত ছিলাম। কি স্বপ্ন দেখতাম জানিনা। তবে এখন দেখি। ভয়াবহ সব দুঃস্বপ্ন। দেখি সেই জমি লোভীরা পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে এদিকটাও দখল করতে আসছে। বলছে, হয় আমাদের মতো লুঠেরা হয়ে মদত দাও, অথবা জবাই হও। জেগে চারপাশটা দেখি। ও-মা, দেখি ঠিক তাই। এদিকেও ওরা চুপচাপ হাজির। পথ দেখাচ্ছে, আশ্রয় দিচ্ছে- ভালোবাসা শেখাচ্ছে, মুখোশ পরা কে যেন কারা। ওরা কি জাতে মুসলমান? না, লুটেরাদের কোনো ধর্ম হয়না। জাদুলাঠিটা দিয়ে খটখটাই। দেখি পালায় কিনা। নইলে তো লাঠিটাকে সাপ বানিয়ে ছুঁড়ে দেবো। দিতেই হবে। যেমনটা ফেরায়নের সামনে ছুঁড়ে দেখিয়েছিলেন পূজনীয় মূসার জাদুকর 'আরোণ'। সেই সাপ, পবিত্র গ্রণ্থের বর্ণনার মতোই ওদের সাপকে গিলে খাবে। ফেরায়নের মহাশক্তিশালী জাদুকর 'জানেস্ 'এবং 'জামব্রেস্' কিস্সু করতে পারেনি। এখনও পারবে না। এসব কথা পবিত্র শান্তির গ্রন্থে পড়েই জেনেছি। শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনেছি। আমি আমার নিজের প্রয়োজনেই, বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, সব কটা পুরাণ পড়েছি। কেউ কোন জবরদস্তি করে ওসব পড়ান নি। তারপর খুব শ্রদ্ধার সঙ্গেই আমার মনোবৈজ্ঞানিক এবং ঐন্দ্রজালিক দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষণ করে অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি।

কেউ তাতে আপত্তি করেন নি। যতো পড়েছি বা পড়ছি ততোই মুগ্ধ হচ্ছি। দিশেহারা মানুষকে, অ-মানুষ বা জন্তু-জানোয়ারের মতো লুটেরাদের থেকে আলাদা করার জন্য বিভিন্ন উপদেশ কে গল্পের মাধ্যমে মনে রাখাবার এবং কাউন্সিলিং-এর কি সুন্দর প্রচেষ্টা, অবাক হয়েছি। বি-শা-ল এরব্যাপ্তি। অনন্তসম এর গভীরতা। ...স্বয়ম্ ভূ।... সোহহম.. এসব এগিয়ে থাকা বিজ্ঞান-ভিত্তিক তত্ত্বকথা ওই ঠুঙ্কোদের হজম করানো মুশকিল। এড়েরা মাথা ফাটিয়েও মগজে ঢোকাতে পারবে না। এতই এগিয়ে থাকা এসব উপদেশ কথা। কিন্তু এতো পড়া সত্ত্বেও, যেটা খুঁজছিলাম সেটাই পাইনি। কোথাও 'হিন্দু' কথাটার উল্লেখ পাইনি। কে হিন্দু? কথাটার মানেটা কি? কোত্থাও উল্লেখ পাইনি। কেউ যদি জেনে থাকেন তো দয়া করে জানাবেন। আমি হয়তো স্লিপ করেছি। যতোটুকু জানি, পারসিকরা উচ্চারণ গত কারণে 'সিন্ধু' কে 'হিন্দু' বলতেন। এই কারণেই সিন্ধুস্তান হয়েছে হিন্দুস্তান। হিন্দুর ধর্মীয় পরিচিতির চেয়ে ভৌগলিক পরিচিতি অনেক বেশি সঠিক। সিন্ধুনদী পাকিস্তানে। সুতরাং পারসীকদের ভাষায় সিন্ধুস্তান, মানে হিন্দুস্থান এখন পাকিস্তানে। ভাববার বিষয়। কী ভাগ করলেন জিন্না, নেহরু পণ্ডিতরা।
বঙ্গ দেশের মাথায় কাঁঠাল ভঙ্গটা না করলে চলছিলো না?

আজব রাজনীতি। আজাদ হিন্দ্ পৌঁছে তো হিন্দু-মুসলমান ভাগটা ছিলো না। ***। ****। *****। ***** দেশের কাঁচা বাড়িটা বাবা পাকা বাড়ি বানিয়ে ঠাকুমার দুশ্চিন্তা দূর করে ছিলেন। কাঁচা বাড়ির মাটির দেওয়াল খুড়ে চোর চুরি করতো। বৃষ্টিতে ভিজে দেওয়াল হয়ে যেতো নরম। ঝ্যামেলা বাড়তো। খড়ের চালে ইঁদুর খুঁজতে সাপ ঢুকতো। বাবা নিজে উপার্জন করে ইট, সিমেন্টের পাকা বাড়ি বানান। ম্যাজিক দেখিয়ে উপার্জন!! বাড়ির নাম ঠাকুর্দা রাখেন "যাদু-ভবন"। সেগুলো কাঠের শক্তপোক্ত দরজায় তালা দেবার ব্যবস্থা হয়। সামনের পুকুর আর বাগানটাকে স_স্কার করেন। দেশ বিদেশ থেকে নানারকম মূল্যবান গাছ, ময়ূর, হরিণ এনে বাগানটা সাজান। আম, কাঠাল আর মেহগনি গাছ দিয়ে করেন ভরপুর। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর, ওই বাড়ির নতুন মালিক বাড়ির নাম পাল্টে রাখেন- "জামান লজ্।" আম, মেহগনি সব বড় গাছ কেটে টানটান জমি করে প্রোমোটারি শুরু করেন। শুনে আমার মা হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেন। কতো স্মৃতি, কতো কিছু মিশে আছে ওর প্রতিটি অনু-পরমাণুতে। মা-র পুরো যৌবনটাই ওখানে মিশে আছে। আমার জন্মের আতুড় ঘরও ওই যাদু ভবনে। বাবা ছিলেন সত্যিকারের জাদুকর। ওই কপর্দকহীন অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের পাঁচ ভাই-বোনেদের জন্য পাঁচটা বাড়ি আর মায়ের জন্য এক বিরাট বাড়ি বানালেন মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যে। ম্যাজিক দেখিয়ে সৎভাবে উপার্জন। আমি কলকাতার দক্ষিণে, বারুইপুরের একটা জমি অনেক কষ্টে-সৃষ্টে ম্যাজিকের উপার্জনেই কিনেছি। চারদিক পাঁচিল দিয়ে গিয়ে তার ভেতর আমার কর্মযজ্ঞস্থল তৈরি করেছি। রিহার্সাল দেবার জন্য বড় স্টেজ, বিরাট গোডাউন, ওয়ার্কশপ্, দুটো পুকুর, আম, কাঠাল, লিচু, বাতাপী লেবু, কদবেল, গোলাপ জাম, জামরুল, ইত্যাদি দিয়ে যতোটা গাছে পারি ভরেছি। 'যাদু-ভবন'এর আদলে একটা বাড়ি বানিয়ে মাকে এবং অলক্ষ্যে আমার ঠাকুমাকে হাসিয়েছি। আমার কন্যেদের আর বৌ-এর আব্দারে একটা দোতলা কটেজ বানিয়েছি।সেটা ন-খানা নারকেল গাছ দিয়ে ঘেরা। তার নাম 'চকোলেটের বাড়ি', পুরো প্রজেক্টের নাম দিয়েছি 'ইন্দ্রলোক'। বন্ধুদেরকে ওখানে পিকনিক করতে দিই। দোল খেলি। সত্যিই ওটা ইন্দ্রলোক। কোলকাতায় ইষ্টকারণ্যে আমরা বসবাস করি।

দেশের বাড়ির কথা উঠলেই আমরা কষ্ট পাই।
অহেতুক ধর্মীয় বিভাজনের কথায় আলোচনা শেষ করি। কষ্ট লাগে। আমরা হিন্দু, ওরা নাকি মুসলমান । ইশ্ এত প্রজন্ম ধরে, এতদিন আমরা ছিলাম, কোনো তফাৎ বুঝিনি। তখন কে, অথবা, কি যেন এসে বিভাজনটা প্রকট করছে। এটা শয়তানের শয়তানী। আমি বা আমরা কট্টর হিন্দু। আমরা সেজন্য শয়তান কে মানিনা। পরমপিতা ঈশ্বরের পূজারী। তিনি হিন্দুও নন, মুসলমানও নন। সেটা জানান দিতেই, হিন্দু হয়েও আমার সবচেয়ে আদুরী কণ্যে, আমার সর্বকনিষ্ঠা মেয়ের নাম রেখেছি, মুমতাজ । আমরা সরকার পরিবার ধর্মীয় বিভেদ মানিনা।

মুমতাজ খাওয়া নিয়ে ভীষণ খুৎ খুৎ করতো। কিন্তু যেই শুনতো যে এটা আমাদের ইন্দ্রলোক’ বাগানের সব্জী, অমনি ও সব কিছু চেটে পুটে খেয়ে নিতো। দুষ্টুমি করতো না। আমাদের তিন কণ্যেই তাই।
ছবিতে মুমতাজের ইন্দ্রলোক- বাগানের আম খাওয়ার কায়দাটা দেখে অনেকেরই লোভ লাগতে পারে।

Be First to Comment