ডঃ পি সি সরকার (জুনিয়র) বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী ও বিশিষ্ট লেখক। ২৩, ডিসেম্বর, ২০২০। কলকাতা ইউনিভার্সিটির M.Sc.র অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজির দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র ছিলাম । নতুন গড়ে উঠছে এই ডিপার্টমেন্ট। র্আমি যখন B.Sc. পাশ করে বাবার কাছে এসে প্রথম বলি, “আমি জাদুকর হতে চাই” , তখন বাবা হেসে বলেছিলেন,”ভালো কথা, কিন্তু জাদুকর হতে গেলে পেটে বিদ্যে থাকার প্রয়োজন..”। আমি তখন লজ্জায়-লজ্জায় বলি, “আমি তো গ্র্যাজুয়েট ..” ।
বাবা হাসেন, বলেন “হ্যাঁ, জানি। কিন্তু ম্যাজিকের সব কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক হলেও সেটা তো আসলে একটা আর্ট! দুঃখ বা ফ্রাস্টেশন কাটাবার ইচ্ছেপূরণ-ধর্মী আর্ট।
আবেগ না বুঝলে, মানে হৃদয়ে সেটা কাটাবার চেতনা না থাকলে, তুমি তো ‘যন্ত্রের কেরামতি প্রদর্শক’ অথবা ‘সার্কাসের জাগলারির মতো, অভ্যাসে আয়ত্ত করা বাহাদূরীর এক ‘ আবেগহীন পরিবেশক’ হয়ে যাবে। তুমি তো বিজ্ঞানের ছাত্র, সেজন্য আবেগের ব্যাপারটা বোধহয় ঠিক বুঝতে পারছো না। সিরিয়াস বিজ্ঞান- সাধকদের এটা এক ‘বস্তু-কেন্দ্রিক’ রোগ।”
বাবা নিজে বিজ্ঞান মনস্ক হলেও কলেজে ছিলেন আর্টস্-এর ছাত্র। কম্বিনেশনে ছিল ইংলিশ, বেঙ্গলি , ইকোনমিক্স এবং অঙ্কে অনার্স। তুখোর ছাত্র। আমি সেজন্য ভেবে বসলাম, জাদুকর হতে গেলে আর্টস্ নিয়ে পড়া দরকার ছিলো। আর সেটাই আমি করিনি।
তখনকার দিনে বি.এস্ সি পাশ করার পর স্পেশাল বি.এ. পরীক্ষা দেওয়া যেতো। আমি লুকিয়ে সেই পরীক্ষায় বসলাম। পাশও করলাম। বাবার কাছে এসে দু’টো ডিগ্রী দেখাই।
এবার বকুনি খাবার পালা। বললেন, “বোকার মতো সময় নষ্ট করেছো। জানো না, ম্যাজিক স্টেজে বা জাদুকরের হাতে তৈরি হয়না ? সেটা তৈরি হয় দর্শকদের মনের ভেতরে। মানুষের মনের খবর না রাখলে মনোরঞ্জন করবে কিভাবে?”
সুতরাং, রওনা হলাম সাইকোলজি নিয়ে এম্ এস্ সি পড়তে। যে -সে সাইকোলজি নয়, অ্যাক্কেবারে অ্যাপলায়েড, ব্যবহারিক মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে। এটা শুধু মুখস্ত বিদ্যায় চলবে না, হাতে-কলমে কাজে লাগিয়ে, প্রমাণ করে ফল দেখিয়ে , মনকে জেনে ফল ফলানোর বিজ্ঞান।
আমাকে ওনারা সহজে অ্যাডমিশন দেন নি। একেবারে কষে অগ্নি পরিক্ষা দিয়ে লড়ে জিতে সেটা অর্জন করেছি।
সে কাহিনী পরের পর্বে বলবো। বিরাট অ্যাডভেঞ্চার ।
ক্লাসের সবাই আমরা খুব আনন্দে ছিলাম। আমরা নোটস্ পরস্পরকে দিতাম। ক্লাসরুম পরিষ্কার রাখতাম, আলপনা দিতাম, পাশের ফিজিওলজির ছাত্রদের গলার আওয়াজ কমাতে, কবিতা লিখে লুকিয়ে শাসন করতে, ওদের দরজায় লাগিয়ে দিয়ে আসতাম । বিদেশ থেকে অধ্যাপকেরা এলে আন্তরিকভাবে আপ্যায়ন করতাম, তাঁদের ঘাবড়ে দিতাম ম্যাজিক দেখিয়ে।
আমরা সবাই মিলে, লেখাপড়ার বাইরে, নাটক করতাম, ম্যাজিক শো করতাম, মূকাভিনয় করতো তপন, ঝর্ণা ফাটাফাটি গান গাইতো, আমার লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় বেড়ুতো। স্যারেরা ছিলেন বড় দাদাদের মতো। ক্লাসে আমাদের চা-ও খাওয়াতেন। আমরা সাউথ ইন্ডিয়াতে এডুকেশনাল এক্সকারশন ট্যুরে গেছিলাম। বাবার মৃত্যু-সংবাদ শুনে আমি জাপানে চলে যাই। ওরা “প্রদীপ ফিরে না আসা পর্যন্ত পরীক্ষায় বসবো না” বলে চুপ করে মাসের পর মাস অপেক্ষা করেছে । বন্ধুত্বের এক নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেছে।
দীপেন নাথ নামক দুর্ধর্ষ মেধাবী মুখচোরা বন্ধুটিকে আমি জোর করে টাই বাঁধিয়ে, হাতা গুটিয়ে উড়নচণ্ডি বানিয়ে ছেড়েছি। সে-সব ছবি হঠাৎ খুঁজে পেলাম, এখানে দিলাম। শুধু আমার ভর্তি হওয়া আর পাশ করার রোমহর্ষক কাহিনীটা এখন লিখলাম না। পরের পর্বে লিখবো বলে তুলে রাখলাম। আমাদের বন্ধুত্ব যুগ যুগ জিও।
নতুন জেনারেশন পড়ে শিখে নিও। আমাদের থেকেও ভালো হবার চেষ্টা করো। স্যারদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করাটা বাদ দিও না। জয় হিন্দ্ ।
Be First to Comment