Press "Enter" to skip to content

প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় সশরীরে আর নেই একথা সত্যি তবে বাঙালির বুকের ভেতর ‘মেলা থেকে কিনে আনা তাল পাতার বাঁশি’ তিনি বাজাবেন যুগের পর যুগ ধরে………

Spread the love

————-স্মরণঃ প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়————

বাবলু ভট্টাচার্য : আজো বাঁশ বাগানের মাথার ওপর যখন চাঁদ ওঠে, পুকুরপাড়ে নেবুর তলে যখন থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে, তখন বেদনা মাখানো মিষ্টি সুরে কে যেন কানে কানে বলে যায়- মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই! সেই কাজলা দিদি প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩৪ সালের ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিক্রমপুরের বাহেরক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মণিভূষণ চট্টোপধ্যায়ের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল গাইয়ে হিসেবে। চমৎকার ঠুংরি, দাদরা গাইতেন। ওস্তাদ বদল খানের শিষ্য ছিলেন। বেশ কিছু গানের রেকর্ডও বেরিয়েছিল তাঁর। আবার ভাল ফুটবলও খেলতেন মণিভূষণ। তবে মাত্র ২৭ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর। তখন প্রতিমার বয়স মাত্র এক বছর। আর যিনি প্রতিমার গর্ভধারিণী, সেই কমলা দেবীরই বয়স ছিল মাত্র ১৮। স্বামীর মৃত্যুতে কন্যাকে কোলে নিয়ে অকূল সাগরে ডিঙা ভাসালেন মা কমলা চট্টোপাধ্যায়। সেই বয়সে মেয়েকে মানুষ করা, সংসার সামলানোর মতো দুই কঠিন দায়িত্ব এসে চাপে তার কাঁধে।

মা চেয়েছিলেন, মণিভূষণ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যাও যেন তার বাবার মতো গান গাইতে শেখে। সংসারে নিত্যদিনের অভাব অনটনের মধ্যেও তিনি একটু একটু করে টাকা জমিয়ে মেয়েকে একটা হারমোনিয়ম কিনে দিয়েছিলেন। প্রাথমিক তালিমটা দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। প্রতিমার বয়স পাঁচ বছর হলে তার গান শেখানোর ভার তুলে দেন পণ্ডিত ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের শিষ্য প্রকাশকালী ঘোষালের হাতে। গান ছিল প্রতিমার রক্তে। আর ছিল মায়াবী কণ্ঠ। প্রকাশকালী সবটুকু উজাড় করে দিয়ে গান শিখিয়েছিলেন প্রতিমাকে। গুরু ভীষ্মদেবের কাছে নিয়েও তিনি পরিচয় করিয়ে দেন প্রতিমাকে। ভীষ্মদেব মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রতিমার গান শুনে। প্রতিমার বয়স তখন সাত কি আট। বিক্রমপুর থেকে ঢাকা শহরে এসেছেন আত্মীয়বাড়ি বেড়াতে। আত্মীয়রা তো বটেই সে বাড়ির আশপাশের লোকজনও প্রতিমার গান শুনে তাজ্জব। তারাই উদ্যোগ নিয়ে ঢাকা রেডিওতে গান গাইবার ব্যবস্থা করে দেন তাকে। কলকাতা বেতারেও গান গাওয়ার সুযোগ এসে যায় সেই কিশোরী বয়সেই। তখন বয়স তার তের কি চোদ্দ। স্কুলের গণ্ডী তখনও পেরোননি। গানের সূত্রেই প্রতিমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলেন সঙ্গীতপ্রেমী সুদর্শন অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বয়সেই প্রতিমা চট্টোপাধ্যায় থেকে হয়ে গেলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিয়ের পর দক্ষিন কলকাতায় এক ঘরোয়া আসরে প্রতিমার গান শুনে মুগ্ধ হন সে সময়ের নামকরা সুরস্রষ্টা সুধীর লাল চক্রবর্তী। তিনিই তাকে দিয়ে ১৯৫১ সালে ‘সুনন্দার বিয়ে’ ছবিতে গাওয়ালেন ‘উছল তটিনী আমি সুদূরের চাঁদ’। সুধীরলাল পাকা জহুরি। রত্ন চিনতে তার ভুল হয়নি। প্রতিমার সে গান বাজিমাত করল সহজেই। সে আমলে লোকের মুখে মুখে ফিরত সে গান। এরপর ১৯৫৪ সালে সঙ্গীত বহুল ছবি ‘ঢুলি’তে রাজেন সরকারের সুরে প্রতিমার সব গানই হিট। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, যুথিকা রায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের মতো ঝানু শিল্পীর পাশে সসম্মানে জায়গা করে নিলেন নবীনা প্রতিমা। এই ছবিতেই প্রতিমার গাওয়া রাগাশ্রিত ‘নিঙাড়িয়া নীল শাড়ি শ্রীমতী চলে’ তো রীতিমতো ইতিহাস সৃষ্টি করল। ১৯৫৫ সালে সূচিত্রা-উত্তম অভিনীত বিখ্যাত ছবি ‘শাপমোচনে’ চিন্ময় লাহিড়ীর সঙ্গে গাওয়া ‘ত্রিবেনী তীর্থ পথে কে গাহিল গান’ সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। রাগাশ্রিত কিন্তু কালোয়াতি আড়ম্বর নেই।

উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের যুগপুরুষ ওস্তাদ আমীর খানের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে গান গাওয়ার দুর্লভ সুযোগ এল ‘ক্ষুধিত পাষান’ ছবিতে। চলচ্চিত্রটির পরিচালক তপন সিংহ সঙ্গীত পরিচালক প্রবাদপ্রতীম সরোদবাদক ওস্তাদ আলি আকবর খানকে বললেন, রবীন্দ্রনাথের ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’ এই গানের সুর নিয়ে কিছু একটা করা যায় কিনা! আলি আকবর তখনই তৈরি করলেন সেই বিখ্যাত গান ‘ক্যায়সে কাটে রজনী ইয়ে সজনী’। এই গানেই ওস্তাদ আমীর খানের সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর ১৯৫৪ সালে পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘যদু ভট্ট’ ছবিতে গাইলেন ওয়াজিদ আলি শা’র সুর দেয়া ইতিহাস সৃষ্টিকারী সেই গান ‘বাবুল মোরা’। এই গানই প্রথম বিএফজে পুরস্কার এনে দেয় প্রতিমাকে। শুধু রাগাশ্রয়ী গানে নয় অন্যান্য ধরনের গানেও প্রতিমা সমান সফল। ১৯৬০ সালে প্রকাশ পাওয়া ‘নতুন ফসল’ ছবিতে পণ্ডিত রাইচাঁদ বড়াল ও ওস্তাদ বিলায়েত খানের সঙ্গীত পরিচালনায় প্রতিমার গাওয়া সেই লোকায়ত গান ‘যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভেজাবো না’ তো আজো সমান জনপ্রিয়। হেমন্ত মুখোপধ্যায়ের সুরে গাওয়া তার ‘কুসুম দোলায় দোলে শ্যাম রায়’। রাইচাঁদ বড়ালের সুরে ‘মাধব বহুত মিনতি’ বা ‘কী রূপ দেখিনু’র মতো কীর্তনাঙ্গের গানও অপরূপ সুসমা পেয়েছে তার কণ্ঠে। অনেক আগে আঙুরবালার কণ্ঠে গাওয়া ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা’ (কথা: ধীরেন চট্টোপাধ্যায়, সুর: ভূতনাথ দাস) ও ‘আমার জীবন নদীর ওপারে’ (কথা: বরদাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত, সুর: ভূতনাথ) ১৯৬৭ সালে নতুন করে গেয়ে সাড়া ফেলে দিলেন প্রতিমা।

প্রতিমার কণ্ঠে ‘বনের চামেলী ফিরে আয়’, ‘জীবন নদীর ওপারে’, ‘আমি গানের মাঝে বেঁচে থাকব’, ‘প্রদীপ কহিল দক্ষিণা সমীরে’, ‘আমি প্রিয়া হব ছিল সাধ’, ‘এল ঘনিয়ে বরষা’, ‘তোমারে চেয়েছি বলে’, ‘তোমার দীপের আলো দিয়ে নয়’, ‘বড় সাধ জাগে’, ‘এ শুধু ভুলের বোঝা’, ‘একটা গান লিখ আমার জন্য’, ‘ক্লান্ত শেফালীরা ঘুমিয়ে পড়েছে’ সর্বোপরি ‘মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি’র মতো কালজয়ী গান ইতিহাস হয়ে আছে।

গানের সুরও রচনা করেছেন প্রতিমা। প্রিয় ‘হেমন্ত দা’র কণ্ঠে তার সুর করা গান ‘শেষের কবিতা মোর’ এবং ‘তন্দ্রাহারা রাত জেগে রয়’ আজও শ্রোতাদের মন উদাস করে দেয়। ভারি মধুর সম্পর্ক ছিল এই দুই সঙ্গীত শিল্পীর মধ্যে।

এত বড়মাপের শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও শেষ বয়সটা কিন্তু মোটেই ভাল কাটেনি প্রতিমার। অত্যন্ত নিঃসঙ্গ অবস্থায় কেটেছে তার জীবনের শেষ দিকটা। মানসিক অসুস্থতাও দেখা দিয়েছিল। কলকাতায় তার সাহা নগর রোডের বাড়ির পাশে এক মুদির দোকানের সামনে দিনের পর দিন মলিন বস্ত্রে বসে থাকতে দেখা গেছে তাকে।

তিনি ২০০৪ সালের আজকের দিনে (২৯ জুলাই) মৃত্যুবরণ করেন।

প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় সশরীরে আর নেই একথা সত্যি তবে বাঙালির বুকের ভেতর ‘মেলা থেকে কিনে আনা তাল পাতার বাঁশি’ তিনি বাজাবেন যুগের পর যুগ।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.