———–জন্মদিনে স্মরণঃ পাবলো নেরুদা———
বাবলু ভট্টাচার্য : গার্সিয়া মার্কেজ বলেছিলেন— নেরুদা বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। তার আগে লোরকার মন্তব্য ছিল— নেরুদা একজন অথেন্টিক কবি যাঁর শরীরী সংবেদন এমন এক পৃথিবীর যা আমাদের নয়। ইলান স্ট্যাভান্স-এর (Ilan Stavans) ভাষায় নেরুদার ব্যক্তিময়তা প্রবাদপ্রতিম। বিচার করে বলতে গেলে তিনি একজন ‘আল্টিমেট পোয়েট’– চূড়ান্ত কবি। আর নেরুদা কবিতার প্রখ্যাত অনুবাদক সেল্ডেন রডম্যান (Selden Rodman) বলেছিলেন পাবলো নেরুদার কবিতার প্রতি উচ্ছ্রিত আবেগ বিষয়ে স্প্যানিশভাষী মানুষের মধ্যে মতবিরোধ নেই। মনোযোগী পাঠক জানেন নেরুদা একপ্রকার নন, বহুপ্রকার। একজন স্পষ্টভাষী, চিৎকৃত, দায়বদ্ধ আর একজন ব্যক্তিগত, নিভৃতমনা, পরাবাস্তবী।
স্টাভান্স বলেছেন বিংশ শতাব্দীর প্রতিটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা নেরুদার কবিতায় স্পন্দিত হয়েছে। সে সব হল— সোভিয়েত বিপ্লব, স্পেনের গৃহযুদ্ধ, নাৎসীবাদ ও স্তালিনবাদ; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎস নিধনযজ্ঞ, সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশকতাবাদ; পরবর্তীকালের ঠাণ্ডাযুদ্ধ, লাতিন আমেরিকার দেউলে রাজনীতি ও অর্থনীতি; ভিয়েতনাম… কিউবার বিপ্লব… ১৯৬৮’র ছাত্রসংগ্রাম ও নিজদেশে সমাজতন্ত্রের আগমন। এইসব বিক্ষোভের সঙ্গে সঙ্গে অন্তরঙ্গ সাধারণ জীবনের দিনলিপিতেও নেরুদা এই সময়কালকে ধরে রেখেছেন। পৃথিবীতে নেরুদার সর্বাধিক বিক্রিত বই হল— ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা’ ও ‘একটি হতাশার গান’। ৯৬-পৃষ্ঠার এই বইটি রচিত হয়েছিল ১৯২৩-২৪-এ; প্রকাশিত হয় ১৯২৪-এ। এ বইটির কেন্দ্রীয়তা প্রেমের, তরুণ প্রেমের আর্তিতে ভূষিত। প্রেমের প্রসঙ্গ তাঁর কবিতায় এসেছে বহুবার, কবি প্রেমের ‘গান’ করেন বাঁচতে, আচ্ছন্ন মনের কষ্ট অতিক্রম করতে। শেষ কবিতাটি লেখা হয় এক জাহাজডুবির পর একটি লাইফ বোট দেখে। এ সময় তিনি পড়ছিলেন রোমা রোলাঁর ‘জাঁ ক্রিস্তফ’ উপন্যাসটি। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার গদ্যরূপ আছে এ বইতে, কিছু বিতর্কও গড়ে উঠেছিল। বাঙালি পাঠকও এ বইটিকে গ্রহণ করেছে অনন্য প্রিয় সম্ভাষণ হিসেবে।
স্পেন গৃহযুদ্ধ নেরুদাকে বদলাতে শুরু করে ক্রমান্বয়ে। মজুররা স্পেন নিয়ে কবিতা প্রকাশের জন্য কাগজ বানায়, যুদ্ধক্ষেত্রে ট্রেঞ্চে ছাপার কাজ চলে, পোস্টারে চলে আসে দীর্ঘ কবিতা। বিষাদ-আচ্ছন্ন কবি যুগের অভিঘাতে হয়ে পড়লেন যুগপ্রকাশক কবি, উচ্চারণ ক্রমশঃ হয়ে ওঠে তীব্র, দায়বদ্ধ কণ্ঠস্বর ফুটে উঠতে থাকে। মহাকবিদের, তাঁদের রচনাবলী নিশ্চিহ্ন করা অসম্ভব। যদিও অনেককাল নেরুদা রচনাবলী প্রকাশ সরকারিভাবে চিলিতে নিষিদ্ধ ছিল, তথাপি শেষপর্যন্ত Hernan Loyola নেরুদা রচনাবলীর পাঁচ খণ্ডের এক রচনাবলী বার করেছে সাম্প্রতিক কালে (১৯৯৯)। এ বইয়ের প্রথম তিনখণ্ড কবিতা সম্ভার। নেরুদার জীবন উপন্যাসের বিষয় হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখ্য—Antonio Skármeta-র লেখা Burning Patience, যার বাংলাও পাঠক এখন পড়তে পাবেন। উপন্যাসেও নেরুদা প্রসঙ্গ যথেষ্ট। নেরুদা জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র হল Il postino, তাছাড়া আছে ডকুমেন্টারি। কবিতা আবৃত্তির রেকর্ডও আছে একাধিক। নেরুদার কবিতা নিয়ে মিউজিকাল কম্পোজিশন অনেক হয়েছে, তার মধ্যে ক্যান্টো জেনারেল প্রাসঙ্গিক রচনাটি উল্লেখ্য। কেউ কেউ জীবন ও কবিতা নিয়ে গানও বেঁধেছেন। এইসব মিলিয়ে বহুমাত্রিক আগ্রহ সঞ্চারের, একজন আধুনিক কবিকে নিয়ে এই বিশ্বব্যাপী সমারোহের আর কোনো তুলনীয় দৃষ্টান্ত নেই।
সেপ্টেম্বর ২৩, ১৯৭৩ সালে নেরুদা ৬৯ বছর বয়সে
সান্তিয়াগো, চিলি-তে মৃত্যু বরণ করেন।
পাবলো নেরুদা ১৯০৪ সালের আজকের দিনে (১২ জুলাই) চিলিতে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment