সঙ্গীতা চৌধুরী: কলকাতা, ৬ অক্টোবর ২০২১। সেই ছোটবেলা থেকেই মহালয়ার সকালে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে তর্পণ করার ব্যাপারটি শুনে আসছি । আমার বাবাকেও দেখেছি তর্পণ করতে যেতে । কিন্তু ‘তর্পণ ‘ – কি ? এই প্রশ্নের উত্তরে সে সময়ই জানতে পেরেছি পিতৃ পুরুষের উদ্দেশ্যে জল দান করা। তখন থেকে বহুদিন অবধি শুধু এটুকুই জেনে এসেছি । তবে পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে ‘তর্পণ’, ‘পিতৃপক্ষ’ এবং ‘মাতৃপক্ষ’ সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়। আর তাতে দেখতে পাই হিন্দু মতে, সারা বছরটিকে বিভিন্ন পক্ষে খুব সুন্দর ভাবে ভাগ করা হয়েছে । এবং প্রতিটি ভাগের ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে । এক একটি পক্ষ ১৫ দিন নিয়ে হয়। চান্দ্র পঞ্জিকা মতে, প্রতিটি মাস দুটি পক্ষে ভাগ করা থাকে। শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষ ।
আবার হিন্দুশাস্ত্রে অনেক রকম তর্পণের কথা বলা হয়েছে যেমন- ঋষি তর্পণ, যম তর্পণ, দেব তর্পণ, রাম তর্পণ, মনুষ্য তর্পণ, পিতৃ তর্পণ, মাতৃ তর্পণ ইত্যাদি । তবে পিতৃ তর্পণই সাধারণ মানুষের কাছে অধিক প্রচলিত । শুধু ভারত বর্ষেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে নানান সময়ে পিতৃ তর্পন পালিত হয় । ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশে গনেশ উৎসবের পরবর্তী পূর্ণিমা। (ভাদ্র পূর্ণিমা) তিথিতে পিতৃপক্ষ শুরু হয় । আর উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, নেপাল ও বাংলাদেশে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণ পক্ষকেই পিতৃপক্ষ বলে । এ সব জায়গায় মহালয়ার দিন অমাবস্যায় পিতৃতর্পণ হয় । হিন্দু ধর্মে এই দিনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । এই দিন তিথি নিয়ম ছাড়াও পূর্বপুরুষদের শ্রাদ্ধ করা যায় । এজন্য যারা কোন কারণে পূর্বপুরুষদের বাৎসরিক শ্রাদ্ধ করতে পারেন না, তারা এই দিনটিতে করেন। হিন্দুধর্মে বিশ্বাস অনুযায়ী, যে ব্যক্তি তর্পণে ইচ্ছুক হন , তাকে তার পিতার মৃত্যু তিথিতে তর্পণ করতে হয় ।
পিতৃ তর্পণের সঙ্গে রামায়ণের রামচন্দ্র এবং মহাভারতের মহাবীর কর্ণ সম্পর্কিত দুটো কাহিনী প্রচলিত আছে । রামায়ণে রামচন্দ্র মহালয়ার দিন পিতৃ পুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করেছিলেন । অনেকে মনে করেন তখন থেকেই পিতৃ তর্পণ শুরু হয়েছে । আবার অন্যদিকে কর্ণ সম্পর্কে যে কাহিনীটি কথিত আছে সেটি হলো, দাতা কর্ণ সবসময় সবাইকে স্বর্ণ, রত্ন ইত্যাদি দান করে গেছেন কিন্তু তিনি পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে কখনো জল বা খাদ্য দান করেন নি। কারণ পিতৃপুরুষদের পরিচয় তার কাছে অজ্ঞাত ছিল। তাই এটা কর্ণের কোন ইচ্ছাকৃত ভুল ছিল না । তা সত্ত্বেও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরে কর্ণের আত্মা স্বর্গে গেলে তাঁকে সেখানে খেতে দেওয়া হতো শুধুই সোনা ও ধনরত্ন ।
কর্ণ ইন্দ্রের থেকে জানতে পারেন যে, তিনি পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে কখনো জল বা খাদ্য দান করেন নি তাই তাঁর সাথে এমনটা হয়েছে । তখন কর্ণ দেবরাজ ইন্দ্রকে তাঁর অনিচ্ছাকৃত ভুলের কথা জানালে ইন্দ্র কর্ণকে এক পক্ষকালের জন্য মর্ত্যে ফিরে গিয়ে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে অন্নজল দেওয়ার অনুমতি দিলেন। এরফলে কর্ণ পাপ মুক্ত হলেন এবং কর্ণ মর্ত্যে ফিরে যে পক্ষকাল পিতৃপুরুষদের অন্নজল দিলেন সেই পক্ষটি পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হলো ।
আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষকেই বলা হয় পিতৃপক্ষ।
পিতৃপুরুষদের জল ও খাদ্য দান করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ! এই ধারণাটির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে পিতৃপক্ষের আসল তাৎপর্য ! বলা হয় যে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে ঋণী , তাই তর্পণ করে সেই ঋণ শোধ করার চেষ্টা করি। কথিত আছে যে, আমাদের পূর্বপুরুষরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের থেকে অন্নজল পেয়ে স্বর্গের উদ্দেশ্যে রওনা দেন । সাধারণত তিন পুরুষের জন্য তর্পণ করা হয়ে থাকে । এর তাৎপর্য হল , বছরের এই বিশেষ একটি পক্ষ আমরা যেন তাঁদের স্মরণ করি, যাদের জন্য এই পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ পেয়েছি।
মহালয়ার দিন পিতৃপক্ষের অবসান ও মাতৃপক্ষের শুরু । অমাবস্যায় পিতৃপূজা সেরে পরের পক্ষে দেবীপূজায় প্রবৃত্ত হতে হয় । তাই দেবী পূজার পক্ষকে বলা হয় দেবীপক্ষ বা মাতৃপক্ষ। মহালয়া হয় পিতৃপক্ষের শেষদিন এবং দেবীপক্ষের শুরুর পূর্ব দিন পিতৃপক্ষে আত্মসংযম করে দেবীপক্ষে শক্তি সাধনায় প্রবেশ করতে হয়।
দেবী শক্তির আদিশক্তি তিনি সর্বভূতে বিরাজ করেন। তিনি মঙ্গল দায়িনী করুনাময়ী । সাধকেরা সাধনা করে দেবীর বর লাভের জন্য দেবীর মহান আলয়ে প্রবেশের সুযোগ করেন বলেই এই দিনটিকে মহালয়া বলা হয় । মহালয়ার পর প্রতিপদ তিথি থেকে দেবী বন্দনা শুরু হয়। কোন কোন অঞ্চলে দেবীর আরাধনা প্রতিপদ থেকে শুরু হয় । আমাদের এখানে ষষ্ঠ তিথি থেকে দেবী বন্দনা শুরু হয় । দুই মতেই দেবী পূজার রীতি প্রচলিত আছে ।
মহালয়া পক্ষের পনেরোটি তিথি হলো – প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী , চতুর্দশী ও অমাবস্যা। পুরো মাতৃপক্ষ জুড়ে মায়ের আরাধনা করা হয় । মহালয়া থেকে দেবীর চক্ষুদানের মাধ্যমে এই মাতৃপক্ষের শুরু এবং শেষ হয় কোজাগরী পূর্ণিমায় , মা লক্ষীর আরাধনা দিয়ে । আমরা সারা বছর এই মাতৃপক্ষের অপেক্ষায় দিন গুনি।
Sangita Chowdhury, many people not very aware about exactly meaning of Mahalaya.but your news absolutely stunning