জন্মদিনে স্মরণঃ পা হা ড়ী সা ন্যা ল
বাবলু ভট্টাচার্য :তিনি হয়ে উঠতে পারতেন অতুলপ্রসাদের ‘দিনু ঠাকুর’ কিংবা ভারতীয় সংগীত মহলের এক পণ্ডিত গাইয়ে। হতে পারতেন ভারতীয় সিনেমার দ্বিতীয় সায়গলও। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তিনি হয়ে উঠলেন অনন্য এক অভিনেতা পাহাড়ী সান্যাল।
সবাক বাংলা সিনেমার সেই যুগে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের গানের গলা থাকলে বাড়তি সুবিধে হতো। প্লে-ব্যাক প্রযুক্তি তখনও চালু হয়নি। ফলে শ্যুটিংয়ের সময় অভিনেতারা ক্যামেরার সামনে সরাসরি গান গাইতেন এবং ক্যামেরা ও শব্দগ্রহণ যন্ত্র সেই অভিনয়কে গান-সহ গ্রহণ করত। আর তাই কৃষ্ণচন্দ্র দে, কাননদেবী, সায়গল, পঙ্কজ মল্লিকের মতো গায়ক-অভিনেতাদের পেয়েছিলাম।
এমনই এক পরিবেশে পাহাড়ী সান্যাল বাংলা সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হন। নিউ থিয়েটার্সের বীরেন সরকার তাকে রামপুরের রাজসভা থেকে তুলে এনে কুন্দনলাল সায়গলের সমগোত্রীয় অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম!
সুন্দর কণ্ঠ ও দেহসৌষ্ঠব থাকা সত্ত্বেও প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে সায়গলের জনপ্রিয়তার দৌড়ে পিছিয়ে পড়েন তিনি। তার কণ্ঠস্বর ছিল মিহি– যা তৎকালীন ধ্বনি রেকর্ডিং পদ্ধতির অনুসারী ছিল না।
পাহাড়ে জন্ম বলে তার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘পাহাড়ী’— পাহাড়ের ছেলে। আসল নাম নগেন্দ্রনাথ সান্যাল।
লখনউয়ের মডেল হাউজ পাড়ার বাড়িতেই পাহাড়ী বড় হয়েছেন। পিতা নৃপেন্দ্রনাথ ব্রিটিশ আর্মিতে সিভিল সাপ্লাই বিভাগে চাকরি করতেন বলে বিভিন্ন জায়গায় তাকে ঘুরতে হতো।
লেখাপড়ার পাশাপাশি নবাব ও কবি ওয়াজেদ আলি শাহের লখনউ শহরের হিন্দুস্থানি সাংগীতিক পরিবেশ, বোল, বন্দিশ, মুজরো, মজলিশ আর বাঈজি আসর বা ‘কোঠা’ পাহাড়ীর সংগীতবোধ আর মেজাজ দুটোই গড়ে দিয়েছিল।
পণ্ডিত ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের সন্ধানে কলকাতায় এসে কিশোর ভীমসেন যোশী, পাহাড়ী সান্যালের বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে কিছুকাল কাটিয়ে গিয়েছেন, এমনও শোনা যায়।
পাহাড়ীর গানের গলা এতটাই ভাল ছিল যে, রাস্তা থেকে তার রেওয়াজ শুনে স্বয়ং ধুর্জটিপ্রসাদ মুখার্জি বিনা আমন্ত্রণে ঢুকে পড়েছিলেন তাদের বাড়িতে। নিজের পরিচয় দিয়ে ঘরে বসে শুনেছিলেন যুবক পাহাড়ীর গান। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে পাহাড়ী ভর্তি হন লখনউয়ের সরকারি পলিটেকনিক কলেজে। সেখানে পড়তে পড়তেই ভর্তি হন তৎকালীন ‘মেরিস কলেজ অব হিন্দুস্থানি মিউজিক’-এ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পাহাড়ীর বাবা ইংরেজ ফৌজের হয়ে ‘মেসোপটেমিয়া ক্যাম্পেন’ যুদ্ধে গিয়ে ধরা পড়েন এবং ওয়ার ক্রিমিনাল হিসেবে বন্দি হন। পরে ওখানেই তার মৃত্যু হয়। পাহাড়ীর বয়স তখন মাত্র বারো।
বাবার স্মৃতি পাহাড়ীর কাছে সারা জীবন ফিরে ফিরে এসেছে স্বপ্নের মধ্যে। আর ওই একই সময়ে আর একজন মানুষ তার জীবনে এসেছিলেন পিতৃতুল্য অতুলপ্রসাদ সেন।
মেরিস কলেজ অব হিন্দুস্থানি মিউজিক-এ ভর্তি হওয়ার প্রথম বছরেই পাহাড়ীর পরিচয় হয়েছিল তার প্রথম প্রেমিকা ও স্ত্রী প্রতিভা সেনগুপ্তর সঙ্গে। খুব সুন্দর গান গাইতেন প্রতিভা।
শোনা যায়, চিত্রগ্রাহক কৃষ্ণগোপালের মাধ্যমে নিউ থিয়েটার্সের প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ‘রূপলেখা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য প্রথম চুক্তিবদ্ধ হলেও, সে ছবিতে কাজ করা হয়নি পাহাড়ীর। কিন্তু তথ্য বলছে, ‘রূপলেখা’ ছবির হিন্দি ভার্সান ‘মহব্বত কি কাসুত’-এ তিনি অভিনয় করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে দু’টি ছবিই মুক্তি পায়। দেবকী বসু তাকে নিউ থিয়েটার্সে নিয়ে আসেন বলেও অনেকে মনে করেন।
সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া, সায়গল, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পৃথ্বীরাজ কপূর, পঙ্কজ মল্লিক, দেবকী বসু, রাইচাঁদ বড়াল, কাজী নজরুল ইসলাম, কানন দেবী, যমুনা বড়ুয়া প্রমুখ বাংলা ছবির প্রথম যুগের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বকে। এদের সান্নিধ্যে পাহাড়ী সান্যাল বাংলা সিনেমার অপরিহার্য অভিনেতা হয়ে ওঠেন।
তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘ইহুদি কি লড়কি’। পরিচালক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। চিত্রগ্রাহক নীতিন বসু। প্রধান চরিত্রে ছিলেন কে এল সায়গল, পাহাড়ী এবং রতন বাঈ। সে ছবিতে উমাদেবীর সঙ্গে তার গাওয়া গান ‘প্রেম কি নাইয়া’।
সে যুগে কলকাতাতেই বাংলা ও হিন্দি দুই ভাষারই ছবি তৈরি হতো। খুব ভাল উর্দু জানতেন ও বলতে পারতেন বলে পাহাড়ী সান্যালকে আমরা বাংলা ও হিন্দি দুই ভার্সানেই কাজ করতে দেখি। যেমন হিন্দিতে- ‘রাজরানী মীরা’, বাংলায় ‘মীরাবাই’, ‘ভাগ্যচক্র’/ ‘ধুপছাঁও’, ‘মায়া’/ ‘মায়া’, ‘দেবদাস’/ ‘দেবদাস’, ‘বড়দিদি’/ ‘বড়িদিদি’ ইত্যাদি।
তার গাওয়া গানও সে যুগে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এবং অতুলপ্রসাদের গানও পাহাড়ী চলচ্চিত্রে একাধিকবার গেয়েছেন।
পাহাড়ী সান্যাল বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি মিলিয়ে প্রায় ১৯৭টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। চারের দশকের গোড়ায় তিনি পৃথ্বীরাজ কপূরের সঙ্গে মুম্বই পাড়ি দেন। সেখানেও ধারাবাহিক ভাবে ‘মৌজ’, ‘মহব্বৎ’, ‘ইনসান’, ‘আনবান’, ‘প্রীত’, ‘মিলন’ ইত্যাদি ছবিতে কাজ করেন।
পাঁচের দশকে কলকাতায় ফিরে আসার পর থেকে পাহাড়ী সান্যাল ক্রমশ চরিত্রাভিনয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন। সেই সময় উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়াদেবী প্রমুখ পরবর্তী প্রজন্মের অভিনেতার সঙ্গেও তিনি চুটিয়ে অভিনয় করেছেন। ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিতে তার অভিনয় ভোলার নয়। ভোলা যায় না ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে তার গাওয়া অতুলপ্রসাদের গানখানি। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে আত্মভোলা পক্ষীবিশারদ জগদীশকেই বা কে ভুলতে পারে!
চিত্ত বসুর ‘জয়া’তে অভিনয় করার জন্য তিনি ‘বিএফজেএ’ পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭৪সালের ১০ফেব্রুয়ারি তিনি ৬৭ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
পাহাড়ি সান্যাল ১৯০৬ সালের আজকের দিনে (২২ ফেব্রু) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment