Press "Enter" to skip to content

পাহাড়ী সান্যাল বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি মিলিয়ে প্রায় ১৯৭টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। চারের দশকের গোড়ায় তিনি পৃথ্বীরাজ কপুরের সঙ্গে মুম্বই পাড়ি দেন….।

Spread the love

স্মরণঃ পা হা ড়ী সা ন্যা ল

বাবলু ভট্টাচার্য : পাহাড়ে জন্ম বলে তার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘পাহাড়ী’— পাহাড়ের ছেলে। কবি অতুলপ্রসাদ সেনের মতে, ‘সার্টেনলি এ ইউনিক নেম।’ আসল নাম নগেন্দ্রনাথ সান্যাল।

১৯০৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দার্জিলিং-এ পাহাড়ী সান্যাল জন্মগ্রহণ করেন।

লক্ষ্ণৌয়ের মডেল হাউজ পাড়ার বাড়িতেই পাহাড়ী সান্যাল বড় হয়েছেন। পিতা নৃপেন্দ্রনাথ ব্রিটিশ আর্মিতে সিভিল সাপ্লাই বিভাগে চাকরি করতেন বলে বিভিন্ন জায়গায় তাকে ঘুরতে হত।

লেখাপড়ার পাশাপাশি নবাব ও কবি ওয়াজেদ আলি শাহের লক্ষ্ণৌ শহরের হিন্দুস্থানি সাংগীতিক পরিবেশ, বোল, বন্দিশ, মুজরো, মজলিশ আর বাঈজি আসর বা ‘কোঠা’ পাহাড়ীর সংগীতবোধ আর মেজাজ দুটোই গড়ে দিয়েছিল।

তার জ্যাঠতুতো দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ সান্যাল বা দ্বিজুদা পাহাড়ীকে গানবাজনার ব্যাপারে খুবই উৎসাহ দিতেন। পণ্ডিত ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের সন্ধানে কলকাতায় এসে কিশোর ভীমসেন যোশী পাহাড়ী সান্যালের বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে কিছুকাল কাটিয়ে গিয়েছেন, এমনও শোনা যায়।

পাহাড়ীর গানের গলা এতটাই ভাল ছিল যে, রাস্তা থেকে তার রেওয়াজ শুনে স্বয়ং ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বিনা আমন্ত্রণে ঢুকে পড়েছিলেন তাদের বাড়িতে। নিজের পরিচয় দিয়ে ঘরে বসে শুনেছিলেন যুবক পাহাড়ীর গান।

ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে পাহাড়ী ভর্তি হন লখনউয়ের সরকারি পলিটেকনিক কলেজে। সেখানে পড়তে পড়তেই ভর্তি হয়েছিলেন তৎকালীন ‘মেরিস কলেজ অব হিন্দুস্থানি মিউজিক’-এ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পাহাড়ীর বাবা ইংরেজ ফৌজের হয়ে ‘মেসোপটেমিয়া ক্যাম্পেন’ যুদ্ধে গিয়ে মেসোপটেমিয়াতেই ধরা পড়েন এবং ওয়ার ক্রিমিনাল হিসেবে বন্দি হন। পরে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। পাহাড়ীর বয়স তখন মাত্র বারো। বাবার স্মৃতি পাহাড়ীর কাছে সারা জীবন ফিরে ফিরে এসেছে স্বপ্নের মধ্যে। আর ওই একই সময়ে আর একজন মানুষ তার জীবনে এসেছিলেন পিতৃতুল্য অতুলপ্রসাদ সেন।

অতুলপ্রসাদ সেনের সঙ্গ পাহাড়ীর জীবনে সবচেয়ে মধুর এবং মর্মান্তিক এক পর্ব। বারো থেকে অতুলপ্রসাদের মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘ ষোলো বছরের সময়কালে পাহাড়ী যেমন অতুলপ্রসাদ ও তার স্ত্রী হেমকুসুমের অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন, তেমনই অতুলপ্রসাদও এই প্রাণখোলা সংগীতপ্রেমে ভরপুর কিশোরটিকে আপন করে নিজের গানের ‘ভাণ্ডারি’ করে রেখে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কৈশোর, যৌবনের উদ্দামতার ঝড়ে পাহাড়ী তা বুঝে উঠতে পারেননি।

মেরিস কলেজ অব হিন্দুস্থানি মিউজিক-এ ভর্তি হওয়ার প্রথম বছরেই পাহাড়ীর পরিচয় হয়েছিল তার প্রথম প্রেমিকা ও স্ত্রী প্রতিভা সেনগুপ্তর সঙ্গে। খুব সুন্দর গান গাইতেন প্রতিভা।

শোনা যায়, চিত্রগ্রাহক কৃষ্ণগোপালের মাধ্যমে নিউ থিয়েটার্সের প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ‘রূপলেখা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য প্রথম চুক্তিবদ্ধ হলেও, সে ছবিতে কাজ করা হয়নি পাহাড়ীর। কিন্তু তথ্য বলছে, ‘রূপলেখা’ ছবির হিন্দি ভার্সান ‘মহব্বত কি কাসুত’-এ তিনি অভিনয় করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে দু’টি ছবিই মুক্তি পায়। দেবকী বসু তাকে নিউ থিয়েটার্সে নিয়ে আসেন বলেও অনেকে মনে করেন।

সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া, সায়গল, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পৃথ্বীরাজ কপূর, পঙ্কজ মল্লিক, দেবকী বসু, রাইচাঁদ বড়াল, কাজী নজরুল ইসলাম, কাননদেবী, যমুনা বড়ুয়া প্রমুখ বাংলা ছবির প্রথম যুগের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বকে। এঁদের সান্নিধ্যে পাহাড়ী সান্যাল বাংলা সিনেমার অপরিহার্য অভিনেতা হয়ে ওঠেন।

প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির নাম ‘ইহুদি কি লড়কি’। পরিচালক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। চিত্রগ্রাহক নীতিন বসু। প্রধান চরিত্রে ছিলেন কে এল সায়গল, পাহাড়ী এবং রতন বাঈ। সে ছবিতে উমাদেবীর সঙ্গে তার গাওয়া গান ‘প্রেম কি নাইয়া’। চলচ্চিত্র- সান্নিধ্যে তার দিশেহারা মন হয়তো নোঙর ফেলার বন্দর খুঁজে পেয়েছিল।

সে যুগে কলকাতাতেই বাংলা ও হিন্দি দুই ভাষারই ছবি তৈরি হত। খুব ভাল উর্দু জানতেন ও বলতে পারতেন বলে পাহাড়ী সান্যালকে আমরা বাংলা ও হিন্দি দুই ভার্সানেই কাজ করতে দেখি। যেমন হিন্দিতে ‘রাজরানী মীরা’, বাংলায় ‘মীরাবাই’, ‘ভাগ্যচক্র’/ ‘ধুপছাঁও’, ‘মায়া’/ ‘মায়া’, ‘দেবদাস’/ ‘দেবদাস’, ‘বড়দিদি’/ ‘বড়িদিদি’ ইত্যাদি।

তার গাওয়া গানও সে যুগে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এবং অতুলপ্রসাদের গানও পাহাড়ী চলচ্চিত্রে একাধিকবার গেয়েছেন।

পাহাড়ী সান্যাল বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি মিলিয়ে প্রায় ১৯৭টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। চারের দশকের গোড়ায় তিনি পৃথ্বীরাজ কপুরের সঙ্গে মুম্বই পাড়ি দেন। সেখানেও ধারাবাহিক ভাবে ‘মৌজ’, ‘মহব্বৎ’, ‘ইনসান’, ‘আনবান’, ‘প্রীত’, ‘মিলন’ ইত্যাদি ছবিতে কাজ করেন।

পাঁচের দশকে কলকাতায় ফিরে আসার পর থেকে পাহাড়ী সান্যাল ক্রমশ চরিত্রাভিনয়ের দিকে সরে যান। সেই সময় উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়াদেবী প্রমুখ পরবর্তী প্রজন্মের অভিনেতার সঙ্গেও তিনি চুটিয়ে অভিনয় করেছেন।

‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিতে তার অভিনয় ভোলার নয়। ভোলা যায় না ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে তার গাওয়া অতুলপ্রসাদের গানখানি। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে আত্মভোলা পক্ষীবিশারদ জগদীশকেই বা কে ভুলতে পারে!

চিত্ত বসুর ‘জয়া’তে অভিনয় করার জন্য তিনি ‘বিএফজেএ’ পুরস্কার পান।

পাহাড়ী সান্যাল ১৯৭৪ সালের আজকের দিনে (১০ ফেব্রু) ৬৭ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

More from CinemaMore posts in Cinema »
More from EntertainmentMore posts in Entertainment »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.