স্মরণ : তু ল সী চ ক্র ব র্তী
বাবলু ভট্টাচার্য : বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ যে, ‘স্বর্ণময়’ হয়ে উঠতে পেরেছিল তার অন্যতম কারণ তুলসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতারা ছিলেন বলে। ‘সাড়ে ৭৪’-এ তুলসী চক্রবর্তী আর মলিনা দেবীকে ছেড়ে যেন উত্তম-সুচিত্রার দিকে চোখই যায় না।
‘পরশপাথর’ ছবিতে সত্যজিৎ রায় তুলসী চক্রবর্তীকে মুখ্য চরিত্রে নির্বাচিত করায়, হাউ হাউ করে কেঁদেছিলেন। ৩১৬ টির মত বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। কোথাও নামমাত্র সম্মানী বা কোথাও সবিনয় অনুরোধে, বিনে পয়সায় অভিনয় করতেন, এই অসাধারণ অভিনেতা। হাওড়ার শিবপুরে, নিজের বাড়ীতে ট্রাম ধরে ফিরে যেতেন স্যুটিং শেষে।
টাক মাথা, ধুতি-হাফ ফতুয়া পরা এই ভদ্রলোক পৌরহিত্য করতেন টাকার জন্য।
পরশপাথরে অভিনয়ের সময়, সত্যজিৎ বাবু, তুলসী চক্রবর্তীকে ট্যাক্সি করে যাতায়াতের জন্য পরামর্শ দিয়ে হাতে টাকা দিয়েছিলেন। দুদিন যাতায়াতের পর তিনি সত্যজিৎ রায়কে বলেছিলেন- এই ট্যাক্সি করে যাতায়াত করতে তিনি পারছেন না। এতে তিনি তাঁর অভিনয়ের স্বত:স্ফূর্ততা হারিয়ে ফেলছেন। তারপর থেকে তিনি আবার ট্রামেই যাতায়াত শুরু করেন।
৩ মার্চ, ১৮৯৯ সালে কৃষ্ণনগরের গোয়ারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তুলসীবাবু। বাবা আশুতোষ চক্রবর্তী রেলে কাজ করতেন বলে, পড়াশোনার জন্য কাকা প্রসাদ চক্রবর্তীর কাছে থাকতেন তিনি। বাবার অকালমৃত্যুর পর মা নিস্তারিণী দেবীকে নিয়ে কলকাতায় এসে তাঁর প্রথম লক্ষ্যই ছিল একটা ভাল চাকরী পাওয়া। ভাল গান গাইতে পারতেন, বিশেষ করে কীর্তনাঙ্গের গান। গিরিশ পার্কের পার্বতী ঘোষ লেনের ব্যায়ামাগারে নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীরচর্চাও করতেন।
কাকার অর্কেষ্ট্রা পার্টির গ্রুপ ছিল। কলকাতার বড়লোক বাড়িতে নানা অনুষ্ঠানে তাঁর দল নাটক করত। তুলসী চক্রবর্তীও সে দলে যোগ দিয়ে কীর্তন ও শ্যামা সঙ্গীত গাইতেন। পরে কাকা স্টার থিয়েটারে যোগ দিলে কলকাতার রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে চিৎপুরের এক মদের দোকানে বয়ের কাজ জোটালেন। কাকা খবর পেলে কাজ ছাড়তে হল। এরপর কাজ নিলেন ঘড়ি সারাইয়ের দোকানে। সেখানে বেশিদিন মন টিকল না। বাড়ি থেকে পালিয়ে বর্মা গেলেন। যে জাহাজে পালালেন সেটিতে ‘বোসেস সার্কাস পার্টি’ও চলেছিল। সেখানেই চাকরি নিলেন। মাঝে মধ্যে শোয়ের ফাঁকে জোকারও সাজতেন। এভাবেই তিনি হাস্য-কৌতুকের প্রতি ঝোঁকেন।
তুলসী চক্রবর্তী সার্কাসে থেকে কিছু খেলা যেমন শিখলেন তেমনি শিখলেন উর্দু ও হিন্দী বলতে। সার্কাসে তিনি ছয়মাস ছিলেন। চলে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলতেন- ‘শরীর থেকে জন্তু-জানোয়ারের গন্ধ বেরচ্ছে দেখে চলে এলুম।’
কাকা তখন ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজ জুটিয়ে দিলেন। সেখানে থিয়েটারের হ্যান্ডবিল ও পোস্টার ছাপা হত। তা দেখে তার অভিনেতা হতে ইচ্ছে করল।
জ্যাঠামশায়কে অনেক অনুরোধ করায় তিনি স্টার থিয়েটারে অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের সাহায্যে ঢোকালেন। সে সময় প্রেসে তার মাইনে ছিল ৩২ টাকা। স্টারে এলেন ৮ টাকার মাইনেতে!
তৎকালীন স্টার থিয়েটারের মালিক ছিলেন অপরেশ মুখোপাধ্যায়। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই চোখে পড়ে যান অপরেশবাবুর। সালটা ছিল ১৯১৬। এই অপরেশবাবুই তালিম দেন তুলসী চক্রবর্তীকে। টপ্পা গান, পাখোয়াজ বাজানো- সব শিখেছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি ‘থেটার’ করার সুযোগও পেলেন। ১৯২০ সালে প্রথম স্টেজে অভিনয় করেন। নাটকের নাম ছিল ‘দুর্গেশনন্দিনী’। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত তিনি স্টার থিয়েটারেই ছিলেন।
পরে যোগ দেন, মনমোহন থিয়েটারে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪২টা নাটকে অভিনয় করেন। শেষ নাটক ছিল- শ্রেয়সী ( ১৯৬০)। তার পর তাঁর শারীরিক অসুস্থতার জন্য (হৃদযন্ত্র) আর মঞ্চে অভিনয় করেননি।
তুলসী চক্রবর্তীর সিনেমা শুরু ১৯৩২ সালে, নিউ থিয়েটারের ‘পুণর্জন্ম’ সিনেমায়। পরিচালক ছিলেন সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। তাঁর শেষ সিনেমা মৃত্যুর আঠারো বছর পর মুক্তি পায় ১৯৭৯ সালে ‘আমি রতন’। ‘শুভদা’য় এক গাঁজাখোরের চরিত্রে অভিনয় করার সময় স্বকন্ঠে গান করেছিলেন।
তুলসী চক্রবর্তী ১৯৬১ সালের আজকের দিনে (১১ ডিসেম্বর) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment