#*আমরা যারা পঞ্চাশ এর কোঠায়*#
টিটো নন্দী : ম্যানহাটান, নিউইয়র্ক, ১২ জুলাই,২০২০। আমরা যারা জন্মেছি গত শতাব্দীর সত্তর এর দশকে, তারা তাদের অজান্তেই বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থেকেছে, প্রত্যক্ষ করেছে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। চলুন না আজ একটু ফ্ল্যাশব্যাকে দেখি ইতিহাসের ফেলে আসা দিনের কাহিনি। শুকতারা আনন্দমেলা পড়তে পড়তে
আমাদের জীবনে প্রথম বিপ্লব আনলো টেলিভিশন এবং টেপরেকর্ডার। আমরা অবাক বিস্ময়ে বোকা বাক্সকে প্রথম প্রত্যক্ষ করলুম। ক্যাসেট এসে সরিয়ে দিল ঐতিহ্যের রের্কডকে। ভেঙে খান খান বিজ্ঞাপনের ট্যাগ লাইন,,, সুখী গৃহকোণ বাজে গ্রামাফোন। এল অমিতাভ স্টাইল। চুলের কাটিংএ মন দিল বাঙালি। লুকিয়ে হাতে সিগারেট। এরপর এল ডিস্কো। সেটা কি বোঝার আগেই বাঙালি কোমর দুলিয়ে নাচতে শুরু করল। পথের পাঁচালীতে বাঙালি অপুর সাথে রেলগাড়ি দেখেছিল,,, কিন্তু সেই রেলগাড়ি যে মাটির তলা দিয়ে হুস করে ছুটতে পারে সেটা এই আমাদের জেনারেশন প্রথম দেখল। দেখলুম ইয়া বড় একটা খেলার স্টেডিয়াম হতে পারে! আর তাতে হৈহৈ করে ভর্তি করে দিলুম লক্ষ লোক, ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ম্যাচকে ঘিরে। তারও আগে এই আমরাই দেখছি কলকাতার বুকে ফুটবলের রাজা পেলেকে খেলে যেতে।
উত্তম না সৌমিত্র, অমিতাভ না রাজেশ খান্না, মান্না না হেমন্ত, ঘটি না বাঙাল, ঋত্বিক – সত্যজিৎ না মৃণাল, কংগ্রেস না সি পিএম এই নিয়ে যখন পাড়ার রকগুলোতে ফাটিয়ে আলোচনা তখনই একদিন অজান্তেই তেলে ভাজা চপ মুড়িকে সরিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো ফাস্ট ফুড। রক এন্ড রোল এর সাথে হাঁউ মাঁউ করে চাউ খেতে খেতে বাঙালি দেখলো ‘পেজার’। প্যাঁক প্যাঁক করে পেজার বাজলে হতচকিত হয়ে বাঙালি দেখত স্ট্যাটাস হেঁটে যাচ্ছে। অবশ্য তারও আগে বাঙালির ঘরে ঘরে ঢুকেছে বি এস এন এল নামক টেলিফোন। সাথে সাথে গজিয়ে উঠল পাবলিক টেলিফোন বুথ, যেখান থেকে বাঙালি দশ বারোবার রং নাম্বার পেরিয়ে বেলা বোসকে পেতে চেষ্টা করতো। সেই সময় অন্ধকারের একটা গল্প ছিল,,, তার শিরোনাম….লোডশেডিং…। সেই গল্প তারাই জানে যারা সেই লোডশেডিং এর স্বাদ পেয়েছে। বাঙালি রাজনীতি করতো। বামপন্থা তখন স্ট্যাটাস। বাঙালি চৌত্রিশ বছর ধরে বিশ্বাস করেছে মুখ্যমন্ত্রীর রোলে জ্যোতি বসু আর বুদ্ধদেবকেই মানায়। বাঙালি রূপকথায় পড়েছিল স্বর্গের নাম সোভিয়েত ইউনিয়ন আর দুষ্টু লোকেদের বাস মার্কিন সাম্রাজ্যে। এবার আসতে আসতে চেইঞ্জ হতে লাগলো দৃশ্যপট। সেই রূপকথার সাম্যবাদী দেশটা হঠাৎই চুরচুর করে ভেঙ্গে পড়তে লাগলো। ঝলমলে বাঙালি মেধাকে ডাকতে লাগল রঙিন আমেরিকা। বাঙালি লাল রঙটাকে চিরস্থায়ী বলে মনে করে শহীদ মিনারটাকে লাল রঙে লেপে দিতে গেছিল, ভাগ্যিস একজন বিখ্যাত ব্যক্তি থামিয়ে ছিলেন। এল কম্পিউটার। তাকে আসতে কত বাধা। ‘মাতৃদুগ্ধ না ইংরেজি’ এই নিয়ে বস্তা বস্তা লেখা থেকে কমিটি। তখন বাঙালি আবার কবিতা লিখতে শুরু করল। যে যত দুর্বোধ্য লিখতে পারতো সে তত আঁতেল। ছবির ক্ষেত্রেও তাই।
এইসবে হেজে যাওয়া বাঙালি একদিন শুনতে পেলো সমস্ত স্বরলিপি ভেঙে নতুন গানের সুর,,, এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই….গান হল জীবন মুখী….তৈরি হল ব্যান্ড।
এবার বাঙালির ঘরে এল কেবল টিভি। রঙিন টি ভিতে পছন্দ মতো চ্যানেল। জন্ম নিল সিরিয়াল। জন্ম নিল চাহিদা অনুযায়ী চলচ্চিত্র বাবা কেন চাকর, বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না,,আরো অনেক কিছু…।
সমাজে এল একটা অদ্ভুত জীব। যে সব কিছু গিলে খেতে চায়। নাম তার প্রোমোটার। বাঙালি দেখলো চিকিৎসায় প্যাকেজ, শিক্ষায় ইনভেস্টমেন্ট। এল বিশ্বায়ন। মা দুগ্গাও এই বদলে যাওয়া সময়ে নিজেকে বদলে নিলেন। এল থিমের পুজো। এই বার এলো একটা ঝড়! যা সব কিছুকে উড়িয়ে নিয়ে গেল, এল মোবাইল ফোন। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম ছড়িয়ে পড়ল শহর থেকে গ্রাম।
বাঙালি এবার চিৎকার করে উঠল পরিবর্তন চাই পরিবর্তন চাই,,,। বড্ড আপন করে নিল বাঙালি এই শব্দটাকে। আর এই শব্দ দিয়ে তৈরি হল স্লোগান,, মা মাটি মানুষ। এই সময় বাঙালি জন্ম দিল একটা বাই প্রোডাক্ট, নাম বুদ্ধিজীবী। আমাদের জন্মের সময় জনপ্রিয় হয়েছিল নকশাল বাড়ি, নতুন শতকে তা মুছে তৈরি হল নন্দীগ্রাম। এর মধ্যে ঝলমল করে এসেছে মল, মাল্টি প্লেক্স, এসেছে অনলাইন শপিং, হলুদ ট্যাক্সিকে পাশ কাটিয়ে ওলা উবের।
সেই উবেরে যেতে যেতে সে শুনতে পেল নতুন স্লোগান জয় শ্রীরাম….। আমরা যারা এই বিবর্তনের আঁচ গায়ে মেখেছি তারা এবার প্রত্যক্ষ করছি করোনার ঝড়।
ছোটবেলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মর্মন্তুদ কাহিনি শুনেছি, পড়েছি। ইতিহাস বই বলেছে হিরোশিমা নাগাসাকির হাড় হিম করা গপ্পোও।
কিন্তু পুরো পৃথিবীকে গিলতে বসা এমন ভাইরাসের ছবি দুঃস্বপ্নেও আমরা দেখিনি, আজ দেখছি। ছোটবেলা থেকে আমাদের জেনারেশন বাংলা বনধ্ দেখেছে, ভারত বনধ্ দেখেছে, কোনো দিন বিশ্ব বনধ্ দেখবো ভাবিনি, তাও দেখে ফেললুম। জানি না আর কত ঝড়ের ছবি রবিনসন ক্রুসোর মতো আমরা দেখবো,,, এর পরও কি লালমোহন বাবুর মতো আমাদের জেনারেশন বলবে না,,, বেশ একটা থ্রিলিং এক্সপিরিয়েন্স হচ্ছে মশাই!!!
Be First to Comment