শুভ জন্মদিনঃ স্যার থমাস শন কনারি।
বাবলু ভট্টাচার্য : বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র জেমস বন্ড। বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক ইয়ান ফ্লেমিংয়ের সৃষ্ট এই অনবদ্য চরিত্র সিনেমার পর্দায় এসেও মানুষের মন জয় করেছে। যুগ যুগ ধরে জেমস বন্ড সিরিজ নিয়ে নির্মিত হয়েছে বহু সিনেমা। তবে এই জেমস বন্ড চরিত্রে যাকে সর্বপ্রথম দেখা গিয়েছিল এবং যাকে এখনো পর্যন্ত সেরা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তিনি শন কনারি। খুব সাধারণ এক পরিবারে জন্ম শন কনারির। বাবা একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন এবং লরি চালাতেন। যার ফলে সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই কেটেছে তার ছেলেবেলা। তবে অন্যদের চেয়ে বেশ দ্রুত গতিতে বেড়ে উঠেছেন শন কনারি। ১৮ বছর বয়সেই তিনি একেবারে প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো উচ্চতা ও শারীরিক গঠনের অধিকারী হয়ে যান। যার ফলে কৈশোরে তাকে সবাই ‘বিগ ট্যাম’ বলে ডাকতো। পরিবারের দারিদ্যতার কারণে অল্প বয়সেই কাজে যোগ দিতে হয়েছে শন কনারিকে। তার কর্মজীবন শুরু হয় দুধ বিক্রির মাধ্যমে। এডিনবার্গে তিনি ঘুরে ঘুরে দুধ বিক্রি করতেন। ১৯৪৬ সালে ১৬ বছর বয়সে ব্রিটেনের রয়েল নেভিতে যোগ দেন শন। তবে ১৯ বছর বয়সে নেভির চাকরি থেকে চ্যুত হন তিনি।এরপর বাবার মতো লরি চালিয়েছেন, লাইফগার্ডের চাকরি করেছেন, দৈনিক মজুরিতে শ্রমিকের কাজও করেছেন শন কনারি। সেই সময়ে এডিনবার্গ কলেজ অব আর্ট-এর মডেল হিসেবে কাজ করেন। তখন তার মডেলিং দেখে অনেকেই প্রশংসা করেন।
তৎকালীন মিস্টার স্কটল্যান্ড তাকে বিনোদন ভুবনে কাজের জন্য অনুপ্রেরণা দেন। সেই অনুপ্রেরণা থেকে তিনি জিম শুরু করেন এবং বডি বিল্ডিংয়ে মনোযোগ দেন। অল্প সময়েই তিনি শারীরিক গঠনে বিস্ময়কর পরিবর্তন নিয়ে আসেন এবং তাক লাগিয়ে দেন। পঞ্চাশের দশকে শুরু হয় শন কনারির অভিনয় ক্যারিয়ার। ১৯৫১ সালে তিনি বিকল্প আয়ের আশায় ‘কিংস থিয়েটার’-এর ব্যাকস্টেজে সহযোগিতার কাজ করতেন তিনি। বডি বিল্ডিংয়ের সুবাদে ১৯৫৪ সালের দিকে ‘সাউথ প্যাসিফিক’ মিউজিক্যালে কাজের সুযোগ পান শন কনারি। এরপর ধীরে ধীরে থিয়েটারের প্রতি আগ্রহ বাড়ে তার। পাশাপাশি সুযোগ পান সিনেমায়। তবে সেটা এক্সট্রা আর্টিস্ট হিসেবে। ১৯৫৪ সালে ‘লিল্যাকস ইন দ্য স্প্রিং’-এ তিনি খুব ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। শন কনারি উল্লেখযোগ্য চরিত্রে প্রথম অভিনয় করেন ১৯৫৭ সালে ‘নো রোড ব্যাক’ সিনেমায়। এতে তিনি একজন ছোট গ্যাংস্টারের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। একই বছর তিনি কেন্দ্রিয় চরিত্রে অভিনয়েরও সুযোগ পান। সেটি ছিল বিবিসির টিভি সিরিজ ‘রিকুইম ফর অ্যা হেভিওয়েট’।
১৯৬২ সাল পর্যন্ত আরও কিছু সিনেমায় ছোট-বড় চরিত্রে অভিনয় করেন শন কনারি। কিন্তু সেভাবে সাফল্যের দেখা পাননি। অবশেষে সাফল্য আসে জেমস বন্ড হয়ে। ১৯৬২ সালে জেমস বন্ড নিয়ে প্রথম সিনেমা নির্মিত হয়। ‘ড. নো’ সিনেমায় 007 তথা জেমস বন্ডের রূপে হাজির হন শন কনারি। ব্যাস, ঘুরে যায় তার ক্যারিয়ারের মোড়। জেমস বন্ড সিরিজের মোট সাতটি চলচ্চিত্রে বন্ড চরিত্রে অভিনয় করেন শন কনারি। এগুলো হচ্ছে- ‘ড. নো’, ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’, ‘গোল্ডফিঙ্গার’, ‘থান্ডারবল’, ‘ইউ অনলি লিভ টোয়াইস’, ‘ডায়মন্ডস আর ফরএভার’ এবং ‘নেভার সে নেভার এগেইন’। এই সিরিজের চলচ্চিত্র শন কনারিকে জেমস বন্ড হিসেবে পরিচিত করে দেয় সবার কাছে। রাস্তায় বের হলে সবাই বলতো- ‘ওই দেখো জেমস বন্ড’। কিন্তু এতে খুশি নয়, বরং বিরক্ত হতেন শন। এই চরিত্রের প্রতি তিনি এতোটাই বিরক্ত হয়েছিলেন যে, তিনি বলতেন- ‘আমি এই জেমস বন্ডকে মেরে ফেলতে চাই’।জানা যায়, ওই সময়ে বন্ধুরা কেউ শন কনারির সামনে জেমস বন্ড নিয়ে কোনো আলোচনাই করতে পারতেন না। বন্ধুরাও বিশ্বাস করতেন, জেমস বন্ড চরিত্রের চেয়েও ভালো অভিনেতা শন কনারি। তাই তার মেধা শুধু এই একটি চরিত্রে সীমাবদ্ধ থাকুক, তা চাইতো না কেউই। জেমস বন্ড চরিত্রে বিরক্তি থেকে অন্য ধারার চলচ্চিত্রে মনোনিবেশ করেন শন কনারি। এবং প্রত্যাশামাফিক সফলও হন। তার অভিনীত ‘দ্য ম্যান হু উড বি কিং’, ‘দ্য আনটাচেবল’, ‘দ্য রক’, ‘দ্য হান্ট ফর রেড অক্টোবর’, ‘দ্য নেম অব দ্য রোজ’, ‘মারনি’, ‘ফাইন্ডিং ফরেস্টার’, ‘দ্য লিগ অব এক্সট্রাঅর্ডিনারি জেন্টলম্যান’, ‘দ্য হিল’, ‘এনট্র্যাপমেন্ট’, ‘রবিন অ্যান্ড মারিয়ান’, ‘দ্য অফেন্স’, ‘দ্য উইন্ড অ্যান্ড দ্য লায়ন’, ‘ফার্স্ট নাইট’ ও ‘দ্য রাশিয়া হাউজ’ ইত্যাদি ছবি দারুণভাবে সফল হয়েছে। ২০০৬ সালে অভিনয়কে বিদায় জানান শন কনারি। এরপর অবশ্য ২০১২ সালে তিনি আবারও ফিরে আসেন একজন ভয়েস অভিনেতা হিসেবে। সে বছর তিনি অ্যানিমেটেড সিনেমা ‘স্যার বিল্লি দ্য ভেট’-এ কণ্ঠ দেন। ব্যক্তিগত জীবনে বহু নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন শন কনারি। ১৯৬২ সালে কনারি বিয়ে করেন অভিনেত্রী ডায়ানে সিলেন্টোকে। তারা ১৯৭১ সাল থেকে আলাদা থাকতে শুরু করেন এবং ১৯৭৩ সালে তারা বিচ্ছেদ করে ফেলেন। ১৯৭৫ সালে শন কনারি বিয়ে করেন মরোক্কান-ফ্রেন্স পেইন্টার মিশেলিন রকাব্রুনকে।
অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন শন কনারি। ১৯৮৮ সালে তিনি ‘দ্য আনটাচেবল’ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে অস্কার লাভ করেন। এছাড়া তিনবার গোল্ডেন গ্লোব, দুইবার বাফটা-সহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
শন কনারি ১৯৩০ সালের আজকের দিনে (২৫ আগস্ট) স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment