জন্মদিনে স্মরণঃ নু স রা ত ফ তে হ আ লী খা ন
বাবলু ভট্টাচার্য : ইসলামের মরমী সাধন মার্গ বা সুফিবাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ আধ্যাত্মিক সঙ্গীতধারা কাওয়ালিকে আধুনিক বিশ্বে নন্দিত ও জনপ্রিয় করেন নুসরাত ফতেহ আলি খান। তার অসাধারণ কণ্ঠের ক্ষমতার জন্য তাকে কাওয়ালি গানের শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের সর্বশ্রেষ্ঠদের একজন গণ্য করা হয়।
জন্মনাম ‘পারভেজ’ কেউ মনে রাখে নি। পিতা ও পূর্বপুরুষের নামের অংশ যুক্ত করে তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত নুসরাত ফতেহ আলি খান হিসেবে। যার অন্য নাম শাহেনশাহ-ই- কাওয়ালি বা কাওয়ালি গানের রাজাধিরাজ।
জীবৎকালেই নুসরাত ফতেহ আলি খান পরিণত হয়েছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তিতে। ৬০০ বছরের পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী মরমী-সুফিবাদী সংগীত ঘরানা কাওয়ালিকে তিনি নিয়ে যান আন্তর্জাতিক উচ্চতায়। পারস্যে দ্বাদশ শতকে যে আধ্যাত্মিক সংগীত ধারা সৃষ্টি হয়ে তুরস্ক, আরব জাহান ও মুঘল ভারতে ছড়িয়ে গিয়েছিল, তাকে বৈশ্বিক শ্রোতার হৃদয়ের মর্মমূলে পৌঁছে দেন তিনি।
তাকে কণ্ঠের জোর, দম, স্ট্যামিনা ও অসামান্য নৈপুণ্যের জন্য বিবেচনা করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠদের একজন সংগীতকার রূপে।
রেকর্ড ও লাইভ কনসার্টে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনায়াসে সুরের ইন্দ্রজাল তৈরি করে শ্রোতাদের বিমোহিত করতে পারতেন। সুর, তাল, লয়ে অপূর্ব পারঙ্গমতায় তিনি গানের বাণী ও বক্তব্যকে উচ্চতর অনুভূতির স্তরে নিয়ে যেতেন। একবাক্যে তিনি সকলের কাছে ওস্তাদ নামে সম্মানিত হন।
মধ্যযুগের সাধক-কবি-ধর্মাত্মাদের দ্বারা রচিত কাওয়ালিকে আধুনিক যন্ত্র-অনুষঙ্গ আর গায়কীর বৈশিষ্ট্যে নবরূপে উপস্থাপন করেন তিনি। ফিউশনের শৈল্পিক সংযোজনে বিভিন্ন খানকা, মাজার, দরগা, দরবার ও ধর্মস্থানের কাওয়ালিকে তিনি বিশ্বসভায় মর্যাদার সঙ্গে হাজির করেন।
পাকিস্তানের শিল্পী হলেও তিনি ছিলেন বিশ্বনাগরিক ও মানবতার কণ্ঠস্বর। ইউরোপ ও আমেরিকায় বিপুল শ্রোতা ছিল তার অনুরক্ত ভক্ত। আর উপমহাদেশের নিরিখে তার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি ছিল ভারতে।
যে কয়জন মানুষ ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিবেশেও সার্বজনীন শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সমাদর ও সম্মান পেয়েছিলেন, নুসরাত ফতেহ আলি খান তাদের নেতৃস্থানীয়।
ভারতীয় সংগীত ও চলচ্চিত্র জগতকেও তিনি সমৃদ্ধ করেছেন তার কণ্ঠ ও সংগীত পরিচালনার বাহাদুরিতে। বিভক্ত পাঞ্জাবের অখণ্ড সংগীত আইকন হয়ে তিনি রূপান্তরিত হন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের দক্ষিণ এশীয় সংগীত ব্যক্তিত্বে।
তার অনুনাসিক কণ্ঠস্বর গানের উপযুক্ত নয় মনে করে তার পিতা ও প্রাচীন-ঐতিহ্যবাহী সংগীত পরিবার তাকে গানের জগতে আসতে নিরুৎসাহিত করেন। সবাই মনে করেছিলেন, কাওয়ালির জগতে জনপ্রিয়তা ও সাফল্য তিনি পাবেন না। কিন্তু ভাগ্যের খেলায় তিনি পরিণত হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কাওয়ালি গানের অন্যতম একজনে।
নিজের অদম্য আগ্রহে ও পারিবারিক ঐতিহ্যে তিনি ১০ বছর বয়সেই পিতা ও চাচাদের সঙ্গে কাওয়ালির আসরের সদস্য রূপে মঞ্চে আসেন। পিতার মৃত্যুর পর দুই চাচা ওস্তাদ মোবারক আলি খান ও ওস্তাদ সালামত আলি খানের সঙ্গে থেকে কাওয়ালি জলসায় অংশ নিতে থাকেন তিনি।
১৯৬৬ সালে নবরূপে তিনি যখন সদলবলে মঞ্চে আবির্ভূত হন, তখন পুরো পৃথিবী অবাক হয়ে দেখে এক শাহেনশাহের আগমন। পাশ্চাত্যর অর্কেস্ট্রারের মতো তিনি প্রাচ্যের ঐন্দ্রজালিক সংগীত ভুবন তৈরি করেন তার দল নিয়ে।
সমকালের সকল বিশ্বসেরা সংগীত প্রতিভা তার বন্ধুজনে পরিণত হন। অনেকে তার সংগে সংগীত অনুষঙ্গ দেন। উপমহাদেশ তো বটেই সমগ্র পশ্চিমাজগত উন্মুখ হয়ে থাকে তার কনসার্টের জন্য। বিবিসি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি তাকে নিয়ে বায়োপিক বানায়। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা তার জীবনী লিপিবদ্ধ করে।
জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিসরে নুসরত ফতেহ আলি খান সংগীতের সাফল্য ও জনপ্রিয়তার শীর্ষতম বিন্দু স্পর্শ করে যখন মারা যান, তখন শুধু কাওয়ালি নয়, সংগীত জগতে হিমালয়ের মতো বিশাল উপস্থিতিতে তিনি অবস্থান করছিলেন। যথার্থ শাহেনশাহ বা রাজাধিরাজের মতোই তিনি ছিলেন ঐতিহ্যবাহী কাওয়ালি গানের সুর সাগরে।
তিনি পাকিস্তানী ও ভারতীয় সিনেমায় গান করেছেন৷ তার জনপ্রিয় গান- ‘ইয়ে জো হালকা হালকা’, ‘মাস্ত মাস্ত’, ‘শাহবাজ কালান্দর’, ‘কিনা সোনা’, ‘মোরা সাইয়া’, তুমহে দিল্লাগি ভুল জানি পড়েগি৷’ তিনি পশ্চিমী সঙ্গীতের সঙ্গে কাওয়ালির অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটান৷
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড, ইউনেস্কো মিউজিক প্রাইজ ও ফুকুওকা এশিয়ান কালচারাল প্রাইজ৷ তার ওপর পাঁচটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মিত হয়েছে৷
বিশ্বখ্যাত এই শিল্পী ১৯৯৭ সালের ১৬ আগস্ট লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন।
নুসরাত ফতেহ আলী খান ১৯৪৮ সালের আজকের দিনে (১৩ অক্টোবর) পাকিস্তানের ফয়সালাবাদে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment