Press "Enter" to skip to content

নিউ নর্মালে ক্লাস শুরুর পর পড়ুয়ারা কি ঠিক আগের অবস্থায় ফিরতে পারবে?…….

Spread the love

সঙ্গীতা চৌধুরী : কলকাতা, ২৮, জানুয়ারি, ২০২১।করোনা অতিমারির কারনে প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। করোনা পরবর্তী নব‍্য স্বাভাবিকতায় ধীরে ধীরে প্রায় সব ক্ষেত্রের দরজা উন্মোচন হয়েছে। অফিস , দোকান বাজার, শপিংমল , রেস্তোরাঁ , সিনেমা, রঙ্গমঞ্চ, ধর্মস্থান , বাস, মেট্রো, ট্রেন, মেলা, উৎসব , এমনকি এই সময় বিধানসভা নির্বাচনেরও দামামা বাজছে। কিন্তু একমাত্র দ্বার রুদ্ধ কেবল শিক্ষাব‍্যবস্থার। এখনও পর্যন্ত অনলাইন ক্লাসেই শিক্ষার্থীদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। প্রতিদিনকার পঠনপাঠন ছাড়া অন‍্যান‍্য সব কাজই ভালো চলছে। তাই দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় পড়ুয়াদের মানসিক অবসাদ যেন গ্রাস না করে সেইজন্য শহরের অনেক স্কুলেই পড়ুয়াদের অনলাইনেই কাউন্সিলিং-এর ব‍্যবস্থা আছে। করোনার প্রকোপ এড়িয়ে কবে স্কুল খুলবে , এখনও পর্যন্ত তার সঠিক আভাস মেলে নি। তবে ফেব্রুয়ারিতে কিছু শিক্ষাঙ্গনের দ্বার উন্মোচনের ইঙ্গিত মিলেছে।

সকালে কয়েক ঘন্টার অনলাইন ক্লাসে সহপাঠীদের সঙ্গে গল্প করার বা খেলার সুযোগ কিছুই মেলে না। শিক্ষক-শিক্ষিকার স্নেহের সাহচর্য থেকেও ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে। আবার দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে বসে কোনমতে ক্লাস করে অনেক পড়ুয়াই পড়াশোনায় মনঃসংযোগ হারিয়ে ফেলছে। একপ্রকার গৃহবন্দি জীবন কাটছে। কিন্তু একসময় তাদের কাছে স্কুলে যাওয়ার ঘন্টা বাজবে ! ফাঁকা ক্লাস ঘরের সারি ,ধুলো ধূসরিত বেঞ্চ, নিস্তব্ধ বারান্দা, ব্ল‍্যাকবোর্ড ও চকের টুকরোগুলো তাদের আহ্বান জানাবে ! দীর্ঘদিন বাড়িতে কাটিয়ে পড়ুয়ারা পুনরায় যখন শিক্ষাঙ্গনে ফিরবে তারা কি আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে ? না কি দীর্ঘদিন স্কুলে না যাওয়ার অভ‍্যাস তাদের মধ্যে কুপ্রভাব ফেলবে। এ ব‍্যাপারে মনোবিদরা কি বলেন দেখা যাক ।

মনোবিদ তিতাস বিশ্বাসের মতে, ” স্কুল তো শুধুমাত্র পুঁথিগত শিক্ষার স্থল নয়, এটা হলো একটা সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্র। তাই অনলাইন ক্লাসে কেবলমাত্র সিলেবাস ভিত্তিক পড়াটাই প্রদান করা যায় কিন্তু একজন পড়ুয়ার পড়াশোনার বাইরেও যে আরো অনেক দিক আছে যা স্কুলে থাকাকালীন তার চারিত্রিক গঠন তৈরিতে সাহায্য করে সেটা স্কুলের বাইরে থেকে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।বাড়িতে থেকে ক্লাস করায় স্কুলের শিক্ষক- শিক্ষিকাদের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখোমুখি যোগাযোগ দীর্ঘদিন বন্ধ আছে। অথচ সাইকোলজিক্যাল দিক থেকে এই পারস্পরিক যোগাযোগ খুবই প্রয়োজনীয়। এই প‍্যানডেমিক সিচুয়েশনে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রায় এক বছর স্কুলে যাওয়ার অভ‍্যাস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় , প্রতিদিনকার জীবনে ডিসিপ্লিন ভীষন ভাবে ব‍্যহত হচ্ছে। স্কুল চলাকালীন ছাত্র-ছাত্রীদের সকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে উঠে স্কুলের জন্য রেডি হতে হয়, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে বসে কোনমতে রেডি হয়ে অনলাইন ক্লাস করার ক্ষেত্রে ,সেই ত‍ৎপরতা থাকে না। অনেকে আবার কখনো কখনো ভিডিও অফ করে অন্য কোন কাজে মেতে থাকে। সেটা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পক্ষে দেখা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে পরবর্তীকালে যখন স্কুল চালু হবে তখন টানা চল্লিশ মিনিট চুপ করে বসে থাকা বা পড়া বোঝার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হবে। আজকাল সোস্যাল মিডিয়া ও নানা রকম অনুষ্ঠান দেখে এমনিতেই ওদের মধ্যে একটা হাইপার অ্যাক্টিভিটির প্রবণতা থাকে। অনেক বাচ্চা মনঃসংযোগ হারায়। যাদের এই সব সমস্যা আগে থেকেই ছিল, তাদের ক্ষেত্রে এগুলো আরো বেশি মাত্রায় দেখা দেবে। আবার কারো বাড়িতে পরিবারের কেউ যদি কোভিড সংক্রমিত হন বা অন্য কোন সমস্যায় থাকেন , তাহলে বাড়িতে সবসময় সেই আলোচনাই চলতে থাকে , অন‍্যদিকে পড়ুয়াটি সারাক্ষণ বাড়িতে থাকায় সেই আলোচনা তারমধ্যে একটা খারাপ প্রভাব ফেলবে। স্কুল চললে অনন্ত আট – নয় ঘন্টা ছেলেমেয়েরা বাড়ির বাইরে থাকে , এতে বাড়ির কথা সে সময় ভুলে থাকে। অনেক বাচ্চা কোভিড স্বাস্থ্য-বিধি মানতে গিয়ে মানসিক উদ্বেগে ভুগছে , আবার অনেকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। যদিও শুধু বাচ্চারাই নয়, বড়রাও অনেকেই এই মানসিক পরিস্থিতির শিকার। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য এই প‍্যানডেমিক সিচুয়েশনটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আর উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা তো আরও বেশি ভুক্তভোগী।”

স্কুল খোলার পর পড়ুয়াদের মধ্যে বিশেষ যে সব সমস্যা তৈরি হতে পারে সে বিষয়ে মনোবিদ জানালেন,
১. পড়ুয়াদের মধ্যে স্কুলে না যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে।
২.স্কুলে টানা চল্লিশ মিনিট ক্লাস করার সময় মনঃসংযোগের অভাব ঘটতে পারে।
৩. দীর্ঘদিন বাড়িতে গৃহবন্দি থাকার পর স্কুলে যাওয়ার পর তাদের মধ্যে চারিত্রিক একটা পরিবর্তন আসতে পারে। কারো কারো মধ্যে হাইপার অ্যাক্টিভিটি ও অ্যাগ্রেসিভনেস বেড়ে যেতে পারে।
৪. খুদে পড়ুয়াদের মধ্যে সেপারেশন অ্যাংজাইটি তৈরি হতে পারে।
৫. স্বাস্থ্য- বিধি মানতে গিয়ে কারো মধ্যে প‍্যানিক তৈরি হতে পারে।
তবে এই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণের জন্য অভিভাবকদের সচেতন ভাবে একটু এগিয়ে আসতে বলেন, যেমন-

(১) পড়ুয়াদের স্কুলের টাইমেই ঘুম থেকে তুলে রেডি করতে হবে , অনলাইন ক্লাসে ও যেন স্কুলের ডিসিপ্লিন মেনে চলে ।

(২) ঠিকমত ভিডিও অন রেখে ক্লাস করছে কিনা সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে।

(৩) পড়ুয়াদের অবসর সময়ে কোন ক্রিয়েটিভ কাজের মধ্যে রাখতে হবে। পড়ার ফাঁকে একটু ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি বা এক্সারসাইজ খুবই জরুরি।

(৪) পড়ুয়ারা যাতে কোনরকম প‍্যানিক না করে , তারজন্য তাদের কাছে স্বাস্থ্য – বিধির বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে হবে।

কলকাতার এক বিখ্যাত সিবিএসই স্কুলের সাইকোলজির অ্যাসিসটেন্ট টিচার সোমদত্তা ব‍্যানার্জি বলেন, “এখন তো স্কুল , কলেজ , ইউনিভার্সিটি সহ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই অনলাইন ক্লাস চলছে । এই অনলাইন ক্লাসের নেগেটিভ দিক অনেক আছে , তবে আমার দীর্ঘ শিক্ষকতার জীবনে আমি লক্ষ্য করেছি , অনলাইন ক্লাসের কিছু পজিটিভ দিকও আছে। অনলাইন ক্লাসটা বাচ্চাদের জন্য একটু ডিফিকাল্ট , কিন্তু স্কুলের একটু উঁচু ক্লাস , কলেজ ,ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের জন্য অনলাইন ক্লাসের একটা সবচেয়ে ভালো দিক হলো যে তাদের লক্ষ্য সাজিয়ে নিতে সাহায্য করে। টিচারদের গাইডেন্স তো আছেই , কিন্তু যখন তারা অনলাইনে ক্লাস করছে তখন তাদের লক্ষ্য কিন্তু নিজেদেরই সেট করতে হচ্ছে। ক্লাসের প্রতি মোটিভেশন অনেক বেশি রাখতে হচ্ছে। এবং সেল্ফ ডিসিপ্লিনেরও দিক আছে। আবার অনেক সময় ডেডলাইনে কোন কিছু ক্লাসের সময় জমা দেওয়া নিয়ে নানা অজুহাত খাড়া করা হয় , কিন্তু অনলাইন ক্লাসে সেই ফাঁকি দেওয়ার জায়গা থাকে না। এইভাবে অনলাইন ক্লাস ডিসিপ্লিনের মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের তৈরি হতে সাহায্য করে।

তবে অনলাইন ক্লাসের সঙ্গে একটা স্কুলের ক্লাসরুমের কোন তুলনাই হয় না। কারন একজন টিচারের উপস্থিতি , স্কুলে যাওয়ায় অনুভূতি , ক্লাসরুমের অনুভূতি সেটা একটা একেবারেই অন্যরকম ব‍্যাপার। এই যে দীর্ঘদিন ধরে ছেলেমেয়েরা অনলাইন ক্লাস করছে , এটার একটা সুদূর প্রসারী প্রভাব যেমন – শারীরিক ভাবে রয়েছে ,তেমনি মানসিক ভাবে ও রয়েছে। মোবাইলের সঙ্গে বাচ্চাদের অ্যাটাচমেন্ট এখন গভীর। অনেক ছেলেমেয়ে ক্লাস চলাকালীন ভিডিও অফ করে অন্য কোন দিকে মন দিচ্ছে। আবার লগইন করছে কিন্তু তারা ক্লাস অ্যাটেন করছে না। অন্য ডিভাইস থেকে হয়তো অন্য কিছু করছে ,আমরা বুঝতে পারছি না। এটা খুব দ্রুত যেমন চালু করা যায় নি , তেমনি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতেও একটু সময় লাগবে। তবে এই সময়টাতে আমরা অভিভাবকদের সব সময় পড়ুয়াদের পাশে থাকতে বলি। কারন একদম খুদে পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়, কারন তারা বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে পারছে না। আবার অন‍্যদিকে অনলাইন ক্লাস চলছে , কিন্তু ক্লাসেও মন বসছে না, তাই অভিভাবকদেরও বুঝতে হবে । এই পরিস্থিতিতে অভিভাবক ও শিক্ষক- শিক্ষিকাদের পাশাপাশি থেকে হাত ধরাধরি করে চলতে হবে। তা না হলে সকলের এত চেষ্টা বিফলে যাবে।”
শেষে একথাই বলবো, ভাইরাস এবার বিদায় নেও ! সময় হয়েছে ! শিক্ষাঙ্গনে নতুন ক্লাস শুরু হবে।

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.