#রান্না য় ভোজ্য তেল ব্যবহারের নিয়ম নীতি, সুস্থ থাকার চাবিকাঠি।#
মৃদুলা ঘোষ: কলকাতা, ২০ জুন, ২০২০।
প্রতিদিনের রান্না য় তেলের ব্যবহার নিতান্তই সাধারণ বিষয় বলে আমরা মনে করি। যেহেতু, তেল ছাড়া রসনা র তৃপ্তি হয় না। যেকোনো রকম ব্যঞ্জন তৈরি তে, সেদ্ধ সবজি তে, জিভে জল আনা আচার তৈরি করতে, এমনকি স্যালাড তৈরিতে ও তেলের ভূমিকা ই প্রধান। কিন্তু এই তেল খাওয়া নিয়ে আমাদের মনে নানা প্রশ্ন। কোন তেল স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী, কোন বয়সি মানুষের জন্য কোন প্রকার তেল খাওয়া উচিত, ইত্যাদি। এগুলো জেনে রাখাও উচিত কারন রান্নায় তেলের ব্যবহার অপরিহার্য। ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় খাদ্য হলো তেল।বিভিন্ন ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লিসারিন এর মিশ্রন তেল আমাদের খেতে হয় শরীরের পুষ্টির জন্য। এক গ্ৰাম ফ্যাট থেকে ১৯ ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়।কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন থেকে যে শক্তি পাওয়া যায়, তার দ্বিগুণ। ফ্যাট বা স্নেহ জাতীয় পদার্থ পাওয়া যায়, দুরকম উৎস থেকে প্রথমত উদ্ভিজ্জ্ব উৎস এবং প্রানীজ উৎস। সরষের তেল, বাদাম তেল, জলপাই তেল, তিল তেল, সূর্য মূখী ফুলের তেল, নারকেল তেল ইত্যাদি আসে উদ্ভিদ থেকে তাই এদের উদ্ভিজ্জ ভোজ্য তেল বলে, যা প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ উৎকৃষ্ট গুনগত মান সম্পন্ন। এই তেল থেকে ভিটামিন এ, ডি, ই এবং ক্যালসিয়াম শরীরে প্রবেশ করে। অন্যদিকে, প্রানীজ উৎস হলো ঘি, মাখন, মাছের তেল এতে উদ্ভিজ্জ উৎস র তুলনায় অনেক বেশি ভিটামিন থাকে। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের গড়ে ২৪০০ক্যালোরি শক্তি লাগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা র মতে, যত পরিমাণ শক্তি দরকার তার ৩৩ শতাংশ সংগ্রহ করতে হয় ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় খাদ্য অর্থাৎ তেল চর্বি থেকে। সেইজন্য, সঠিক পরিমাণ মতো ফ্যাট যুক্ত, যার মধ্যে বিভিন্ন শাকসবজি, ফল রয়েছে। বাকি ক্যালোরি আসে তেল ঘি মাখন এর মাধ্যমে। মোটামুটি হিসাবে দেখা গেছে বাঙালিরা প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে ৭ চামচ তেল খায়। কখনো আমরা ভেবে দেখেছি কি , যেকোনো রান্না করতে তেলের প্রয়োজন বলেই কি তেল খাই, নাকি তেল খাওয়ার দরকার আছে।
আসলে, শরীরের প্রয়োজনেই তৈলাক্ত খাবার খেতে হয়। দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনে, দেহের শক্তি যোগাতে, দেহের গড়ন ঠিক করতে, শরীরের নানা স্থানে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কে সচল রাখতে, সর্বোপরি, খাবার স্বাদময় করতে ফ্যাট বা চর্বি র দরকার হয় যা পরোক্ষভাবে তেলের ভিটামিন গুলি আমাদের সুস্থ রাখে। তেলে থাকা ফ্যাটি অ্যাসিড, স্যাচুরেটেড, আন স্যাচুরেটেড, মোনো আন স্যাচুরেটেড আ্যসিড প্রত্যেকেটি আমাদের শরীরে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে কাজ করে। বিশেষত, হার্ট সংক্রান্ত যে কোনো কাজ যেমনঃ- রক্ত সঞ্চালনে প্রক্রিয়া, হৃদধমনী র প্রসারতা, সঠিক মাত্রায রক্ত জমাট বাঁধা য়, হার্টের সংকোচন প্রসারনে এই ভোজ্য তেলের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু চিন্তা র বিষয় যখন আমাদের শরীরে ভেজাল তেল খাদ্যের মাধ্যমে রক্তে মিশে যায়, বা নিয়মিত অতিরিক্ত তেল যুক্ত খাবার খেতে থাকলে। এর প্রভাব শরীরে প্রবেশ যেমনঃ- রক্তে কোলেস্টেরল এর পরিমাণ বৃদ্ধি রক্তনালী তে পলির মতো ফ্যাট জমে রক্ত চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে, রক্তনালী শীর্ণ হয়ে ক্রমশ বন্ধ হয়ে যায়। যার পরিনাম হার্ট অ্যাটাক, বা দীর্ঘ কালীন হার্টের অসুখ। অতিরিক্ত ফ্যাট থেকে দেহের ওজন বাড়ে, হাই ব্লাড প্রেসার, ব্লাড সুগার আসতে থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন কঠিন অসুখের পিছনে এই অতিরিক্ত ফ্যাট এর ভূমিকা থাকে। কোন তেল খাওয়া বেশী পুষ্টিকর সেটা সরাসরি বলে দেওয়া যায় না। তেল দুপ্রকার-স্যাচুরেটেড ও আন স্যাচুরেটেড। স্যাচুরেটেড তেল হল ঘি মাখন, বনস্পতি, নারকেল তেল, এগুলো বেশি খাওয়া ভালো নয়। সান ফ্লাওয়ার তেলে স্যাচুরেটেড কম থাকে, অন্যদিকে, ওমেগা সিক্স, ওমেগা থ্রি র অনুপাত নির্দিষ্ট থাকে, ভিটামিন ‘ই’ ও থাকার জন্য হার্টের রোগীরা বিনা বাধায় পরিমিত পরিমাণে খেতে পারেন। রাইস ব্র্যান তেল ও খুব উপকারী। এতে গামা ওরাইজেনোল নামে যে রসায়নিক আছে, তা রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। অলিভ তেলের তো তুলনাই নেই। এর বাড়তি ভার্জিন ভ্যারাইটি শরীরের জন্য উপকারী। তবে সব রকমের ফ্যাটি আসিডের গুন পেতে হলে সবরকম তেল যেমন সরষের তেল, রাইস ব্র্যান, অলিভ তেল, সয়াবিন, সান ফ্লাওয়ার, সব মিলিয়ে রান্না করা খাদ্যের পুষ্টি বেড়ে যায়। তেলের উপকার পূর্ণ মাত্রার পেতে হলে, দিনের এক একটা পদ এক একটা তেলে রান্না করতে হবে। যেকোনো তেল ব্যবহারের সময় তেলে র স্মোক পয়েন্ট এর কথা মাথায় রাখতে হবে। অর্থাৎ, কোন তেল কত পরিমান তাপ সহ্য করতে পারে। কত তাপমাত্রা য় জ্বলে গিয়ে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করতে শুরু করে। তাই অলিভ তেলে র স্মোক পয়েন্ট সবথেকে কম বলে, এই তেল সেদ্ধ সবজি তে, স্টিম দিতে, স্যালাড মাখতে অলিভ তেল ব্যবহার করলে ভালো হয়। তবে বাঙ্গালী র রান্না ঘরে যে তেল টা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় তা হলো সরষের তেল। এই তেল সস্তা, সহজলভ্য, পুষ্টিকর। সরষের তেলে ট্র্যান্স ফ্যাট থাকে না, স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও কম থাকে প্রায় ৯০শতাংশ জুড়ে থাকে আন স্যাচুরেটেড ফ্যাট ফলে সরষের স্বাস্থ্য গুন ও অনেক বেশি। পুষ্টি বিদ গন বলেন, প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় সরষের তেলে রান্না করা ব্যাঞ্জন অবশ্যই রাখা উচিত। সরষের তেলে রান্না করা খাবার খিদে বাড়াতে সাহায্য করে কারণ, পেটের গ্যাসট্রিক জুস কে উত্তেজিত করে। হজম ও হয় সহজে। সরষের তেলে র আ্যন্টিফাংগাল প্রপার্টি প্রস্রাব সংক্রমণ সংক্রান্ত জটিলতা থেকে মুক্তি দেয়। আ্যজমা, সর্দি কাশি প্রতিরোধে সাহায্য করে। আমাদের পরিচিত আরও কিছু তেল আছে যেমন রেপসিড, তৈলবীজ থেকে তৈরি, সরষে গোত্রভুক্ত উদ্ভিদ জাত এই তেল নিশ্চিন্তে খাওয়া যায়। নারকেল তেলঃ- ভারতের দক্ষিণ ভাগের মানুষই নারকেল তেল খেতে অভ্যস্ত। স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড থাকায় হৃদরোগের সম্ভাবনা কম। পাম তেলে থাকে প্রায় ৫০শতাংশ স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড , আ্যন্টিঅক্সিড্যান্ট, ভিটামিন ই সমৃদ্ধ পাম তেল সহজপাচ্য, অনেক দিন রেখে দিলে গন্ধ ছড়ায় না। তবে এই তেলের ব্যবহার কম।
বনস্পতি তেল:- কয়েক ধরনের উদ্ভিদ তেল কে উচ্চ তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন গ্যাস প্রয়োগ করে জমিয়ে বনস্পতি তেল তৈরি করা হয়। এর ফলে অসংপৃক্ত ফ্যাটি আসিড, ফ্যাটি আসিড এ রূপান্তরিত হয়। এই তেল খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়। বর্তমানে মাছের তেলে যে উপকারী তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। কারন, দেশ বিদেশের পুষ্টি বিজ্ঞানীরা এখন মাছ খাওয়ার উপর জোর দিচ্ছে। অন্যান্য প্রানীজ তেলের মতোই মাছের তেলে সবরকম ভিটামিন আছে। বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এখানে পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি আসিড থাকে যার প্রচুর পুষ্টি গুন আছে। মাছের তেলের বিভিন্ন পুষ্টি গুন শরীরের অপ্রয়োজনীয় মেদ কমাতে, রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমাতে সাহায্য করে, অন্যদিকে, ধমনীর দেওয়াল কে নমনীয় রাখতে সহায়ক হয়। তবে, রান্নায় যেকোন তেলের ব্যবহার অবশ্যই পরিমিত করতে হবে। সাময়িক রসনা র তৃপ্তি যেন ভবিষ্যতে শারীরিক সমস্যায় পরিনত না হয় সে ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্কতা প্রয়োজন। পরিবারের যে কোন দীর্ঘস্থায়ী অসুখে পীড়িত মানুষ থাকলে তার তেল খাওয়ার ব্যাপারে কোন তেল উপযোগী হতে পারে তা একজন চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ব্যবহার করা উচিত।
Be First to Comment