জন্মদিনে স্মরণঃ শি ব না থ শা স্ত্রী
বাবলু ভট্টাচার্য : চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী, সমাজ- সংস্কারক, পন্ডিত এবং ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হিসেবে তিনি ছিলেন সমধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। সমাজ উন্নয়নের ধারায় তাঁর অবদান আজও গভীয় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।
তিনি উজ্জ্বল আলোকিত মানুষ শিবনাথ শাস্ত্রী।
তাঁর পিতার নাম হরানন্দ ভট্টাচার্য আর মাতা কামিনী ভট্টাচার্য। উনিশ শতকের আরেক আলোকিত মানুষ, বিশিষ্ট সমাজ-সংস্কারক, ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার সম্পাদক দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ছিলেন তাঁর মামা।
তিনি মামার আদর্শেই বড় হতে থাকেন। শৈশব-কৈশোরেই নানা বিষয়ে তিনি কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। অন্য বালকদের মতো খেলাধুলায় তেমন মন ছিল না শিবনাথের, বরং মামার তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন বিষয়ের গ্রন্থপাঠে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। এভাবে শৈশব-কৈশোরেই শিবনাথের চেতনায় উপ্ত হয়েছিল উত্তরকালীন বিপুল সম্ভাবনার বীজ।
এ-কারণে মামা দ্বারকানাথের তত্ত্বাবধানেই শেষ হয় তাঁর বাল্যের পাঠ। অতঃপর মামার ইচ্ছানুসারে প্রথমে ভর্তি হন সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে। পরবর্তীতে বিখ্যাত সংস্কৃত কলেজে। সেখান থেকে ১৮৭২ সালে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে তিনি এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
এম এ পরীক্ষায় ভালো ফল লাভ করায় তিনি অর্জন করেন ‘শাস্ত্রী’ উপাধি। পারিবারিক পদবি ‘ভট্টাচার্য’-এর পরিবর্তে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন শিবনাথ শাস্ত্রী নামে।
উনিশ শতকের মধ্যপাদে শিবনাথ
ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হরানন্দ ছিলেন রক্ষণশীল গোঁড়া ব্রাহ্মণ। তিনি শিবনাথকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। স্ত্রীকে নিয়ে শিবনাথ চিরকালের মতো বাড়ি থেকে বের হয়ে যান।
ক্রমে শিবনাথ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন। ইতোমধ্যে ১৮৬৮ সালে ব্রাহ্ম-আন্দোলনের নেতা কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠা করেন Indian Reforms Association।
এসব আদর্শের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে শিবনাথ যোগ দেন সেই সংস্থায়। শিবনাথ, কেশবচন্দ্রের প্রধান সহযোগী হিসেবে এ সময় সমাজ সংস্কারমূলক অনেক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
দেশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় ১৮৭৭ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী গঠন করেন ‘গুপ্ত বৈপ্লবিক সমিতি’। এই সংস্থার প্রধান কর্মসূচি ছিল– জাতিভেদ অস্বীকার, সরকারি চাকরি প্রত্যাখ্যান, সমাজে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, অশ্বারোহণ ও বন্দুক চালনা শিক্ষা, জাতীয়তামূলক ও সমাজ সংস্কারমূলক শিক্ষা এবং পূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা। এসব উদ্দেশ্য থেকেই শিবনাথ শাস্ত্রীর রাজনৈতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৮৭৪ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরস্থ সাউথ সুবার্বন স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেন। দু’বছর পর তিনি যোগ দেন হেয়ার স্কুলে, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক রূপে। এ সময় মামা দ্বারকানাথ শিবনাথ শাস্ত্রীর উপর হরিনাভী স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁর দক্ষ পরিচালনায় উল্লিখিত স্কুলগুলোতে পঠন-পাঠনে ইতিবাচক নানা পরিবর্তন সূচিত হয়।
১৮৮৩ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে ‘সখা’ নামে ভারতের প্রথম কিশোর মাসিক প্রকাশিত হয়। অভিন্ন সময়ে ‘তত্ত্বকৌমুদী’ (১৮৮২) এবং ‘ইন্ডিয়ান মেসেজ’ (১৮৮৩) নামে দুটি ক্ষণস্থায়ী পত্রিকা সম্পাদনা করেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ১৮৯৫ সালে তাঁর সম্পাদনায়
প্রকাশিত হয় বিখ্যাত কিশোর মাসিক ‘মুকুল’।
বাংলা সাহিত্যের একজন খ্যাতিমান লেখক হিসেবে শিবনাথ শাস্ত্রীর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়- ‘মেজবৌ’, ‘নয়নতারা’, ‘যুগান্তর’, ‘বিধবার ছেলে’, ‘নির্বাসিতের বিলাপ’, ‘হিমাদ্রি কুসুম’, ‘পুষ্পাঞ্জলী’, ‘ছায়াময়ী’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয় শিবনাথ শাস্ত্রীর কালজয়ী গ্রন্থ ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’- যা ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য দলিল হিসেবে উত্তরকালে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
১৯১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শিবনাথ শাস্ত্রী কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
শিবনাথ শাস্ত্রী ১৮৪৭ সালে আজকের দিনে (৩১ জানুয়ারি) দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার চাংড়িপোতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment