Press "Enter" to skip to content

দেবানন্দপুরে শরৎচন্দ্রের জন্মস্থানে….।

Spread the love

ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ২৬ অক্টোবর, ২০২৫। বাংলা ভাষার সর্বকালের জনপ্রিয়তম কথা সাহিত্যিক “শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ” জন্মস্থান
( জন্ম- দেবানন্দপুর , হুগলী -১৫সেপ্টেম্বর ,১৮৭৬, বাং -৩১ ভাদ্র ১২৮৩ : প্রয়াণ -কলকাতা -১৬ জানুয়ারী ১৯৩৮) হুগলী জেলার ব্যান্ডেল জংশন স্টেশন থেকে মাত্র মিনিট দশেক গেলেই ( আনুমানিক তিন কিমি)এক সময়ের বর্ধিষ্ণু গ্রাম দেবানন্দ পুরে ৷ যে গ্রাম সম্পর্কে রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র শরৎবাবু জন্মের অনেক আগে লিখেছিলেন ,” দেবের আনন্দ ধাম দেবানন্দপুর গ্রাম ৷ তাহে অধিকারী রাম রামচন্দ্র মুন্সী ৷ ভারতে নরেন্দ্র রায় দেশে যার যশ গায় ৷ হয়ে মোর কৃপাদায় পড়াইল পারসী “৷শরৎচন্দ্রের জীবন নানা সময় বিভিন্ন জায়গায় কাটলে ৷জন্ম থেকে শৈশব এবং কৈশোর – যৌবনের সন্ধিক্ষণের কয়েকটা বছর এখানে কেটেছে ৷ শরৎবাবু জন্মেছিলেন মাটির বাড়ীতে ৷ পরে বাবা বৈঠকখানা সহ দু’কামরার দালান বাড়ী করেন ৷পরে এই বাড়ীটি ২২৫ টাকায় নিলাম হয়ে যায় ৷ ১৯৭৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাড়ীটি অধিগ্রহণ করেন ৷ জন্মস্থানটি ও বৈঠকখানা সংস্কার করা হয় ৷ দেখে আসি দেবানন্দপুর গ্রামের বাউন্ডুলে ছেলে “ন্যাড়া” ( শরৎচন্দ্রের ডাক নাম) কোন জায়গায় জন্মে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল রত্নে পরিণত হয়েছিলেন ৷শরৎচন্দ্র লেখার প্রতিভা ও অস্থিরমনা স্বভাব পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকে ৷ গরিব ব্রাহ্মণ উপরি উপার্জনের জন্য যাত্রা পালা লিখতেন ৷ যে প্যারী বা পিয়ারী (বন্দ্যোপাধ্যায়ের)পন্ডিতের পাঠশালায় তাঁর প্রথম লেখাপড়া সেই স্কুলটিও ৷ বাবা মতিলাল পাঁচ বছর বয়সে পিয়ারী মাস্টারের কাছে ছেলেকে পড়তে দিলেন ৷ দুষ্টুমিতে অতিষ্ট হয়ে যেতেন শিক্ষক মশাই ৷এখানে তিনি দু তিন বছর পড়েছিলেন ৷একবার স্লেটে লিখতে দিলে ন্যাড়া লিখেছিল ,” তুই একটি গাধা” ৷ তারপর যা হয় মাস্টারমশাইয়ের বেতের ভয়ে পাঠশালা থেকে পলায়ন ৷ পন্ডিত মশাইয়ের ছেলে কাশীনাথ ছিলেন লেখকের সহপাঠী ও বাল্যবন্ধু ৷ “শ্রীকান্ত ” ও “দেবদাস উপন্যাসে রয়েছে পাঠশালায় ন্যাড়ার দৌরাত্ম্যের কাহিনী ৷ আর “কাশীনাথ ” গল্পটিতো ঐ বন্ধুর নামে মাত্র সতেরো বছর বয়সে লিখেছিলেন ৷এরপর তাঁকে ভর্তি করা হয় সিদ্ধেশ্বর ভট্টাচার্যের বাংলা স্কুলে ৷মোহন মুন্সীর দালানে বসা ঐ স্কুলে তিনি “আদ্যপাঠ” ও “বোধদয়” পড়েছিলেন৷ অলসতা ও অনিয়মিত চাকরীর জন্য দারিদ্রতা বাড়ায় ১৮৮৬ সালে গ্রাম ছেড়ে মতিলাল চলে যান শ্বশুরবাড়ি বিহারের ভাগলপুরে ৷ শরৎচন্দ্রের দাদামশাই (মায়ের বাবা) কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ২৪ পরগণার হালিশহরে বাড়ী হলেও কালেক্টারি অফিসে কর্মসূত্রে ভাগলপুরে থাকতেন ৷ মামার বাড়ীতে যাওয়ার পর দূরন্ত ও লেখাপড়ায় অমনোরোগী শোরো (শরৎকে মা ভুবনমোহিনী এভাবে ডাকতেন) একবারে বদলে যায় ৷ হয়ে যায় শান্ত ও মেধাবী ৷ খেলাধূলা ও দুষ্টুমির বদলে লেখাপড়া ও শরীর চর্চায় মনোযোগী হন ৷ বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় শুধু প্রথম নয় ডবল প্রমোশন পান ৷ মতিলালের ডিহিরির চাকরি চলে যাওয়ায় ১৮৮৯ সালে আবার তাঁদের পরিবার দেবানন্দপুরে ফিরে আসলে ঐ বছর জুলাই মাসে হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলে ফোর্থ ক্লাসে তাঁকে ভর্তি করা হয় ৷১৮৯২ সালে দারিদ্র্যের জন্য স্কুলের ফি দিতে মা পারায় বিদ্যালয় ত্যাগ করতে হয় ৷ এমন কি ট্রান্সফার সার্টিফিকেটও নিতে পারেন নি ৷আর এখন যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে শরৎচন্দ্র বাড়ী থেকে ঐ স্কুলে যেতেন সেই পথের নাম এখন “শরৎ সরণী “৷
থেটারের ( থিয়েটার) নেশা তাঁর পেয়ে বসে ৷ গ্রামের জমিদার অতুলচন্দ্র দত্ত মুন্সীর কথায় নিজে নাটক লিখে পুরস্কারও পান ৷এই সময় তিনি “কাশীনাথ” ও “ব্রহ্মদৈত্য” নামে দুটি গল্প লেখেন ৷ কিন্তু , সাংসারিক অনটনে ১৮৯৩ সালে আবার তাঁদের ভাগলপুরে ফিরে যেতে হয় ৷ অভাবে মতিলাল চট্টোপাধ্যায় দেবানন্দপুরের ভিটে মাটি বিক্রি করে দেন ৷যেখানে তাঁর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু হয়ে ওঠেন রাজু বা রাজেন্দ্রনাথ মজুমদার ৷ প্রবেশিকা বা এন্ট্রাসের পর এফ এ পড়ার সময় রাজুই তাঁকে বাউন্ডুলে ভবঘুরে বানায় ৷ আসলে এই রাজুকেই শরৎচন্দ্র “শ্রীকান্ত” বলে লিখেছিলেন ৷ রোমাঁ রোলাঁ যে উপন্যাস পড়ে বলেছিলেন এর নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত ৷১৮৯৫ সালে মা মারা গেলে তাঁদের পরিবার খঞ্জরপুর গ্রামে উঠে আসেন ৷ এখানে সাহিত্যমোদী বন্ধুদের “সাহিত্য চক্রে” অধিক মনোযোগী হওয়ায় কলেজের ফল ভাল হয় না ৷ গড়ে তোলেন ” কুঁড়ি সাহিত্যিক ” বলে সাহিত্য সভা এবং বের করেন হাতে লেখা “ছায়া ” পত্রিকা ৷ তারপরের কাহিনীতো সবার জানা ৷ নানা চাকরী ছেড়ে পাকাপাকিভাবে সাহিত্য চর্চা ৷ যিনি শত অর্থকষ্ট সত্ত্বেও সেবা করেছেন বাংলা সাহিত্যকে !তাই মনেহয় তাঁর লেখা আমাদের কাঁদায় ৷ শরৎবাবুরা তিন ভাই শরৎচন্দ্র , প্রভাসচন্দ্র ও প্রকাশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ৷ তাঁর দুই বোন ছিলেন সবার বড় দিদি অনিলা দেবী এবং সবচেয়ে ছোট বোন সুশীলা দেবী ৷ অনিলা দেবী ছদ্মনামে পরে শরৎচন্দ্র অনেক লিখেছেন ৷ শরৎবাবু লিখেছিলেন ,” পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বড় সত্য এই যে মানুষকে সদুপদেশ দিলে কখনো ফললাভ হয় না ৷ সৎ পরামর্শ কিছুতেই কেহ শুনে না ৷দেবানন্দপুরে তাঁদের বাড়ীর কাছে দ্বিজেন্দ্রনাথ মুন্সীর উদ্যোগে ১৯৩৯ সালে হয় ,” শরৎ স্মৃতি সমিতি “৷ ঐ পরিবারের জমিতে বাংলার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দানে স্মৃতি মন্দিরটি তৈরী হয় ৷ ১৯৫৯ সালের ২৬ জুলাই তৎকালানী কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রী কেশকর এর দ্বারোদ্ঘাটণ করেন ৷ পৌরহিত্য করেন সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ ১৯৬০ সালের ১ জানুয়ারী রাজ্য সরকার শরৎচন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারকে গ্রামীণ গ্রন্থাগারের মর্যাদা দেয় ৷ ১৯৭৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৫৭টি দৃশ্যে ১৫২টি মাটির পুতুলে গোপালচন্দ্র রায় রচিত শরৎ জীবনী অবলম্বনে বিশিষ্ট শিল্পী তৈরী করেন ৷সেখানে রয়েছে শরৎচন্দ্রের ব্যবহৃত জিনিস নিয়ে একটি জাদুঘর ৷এখানকার মিউজিয়ামে আছে শরৎবাবুর ব্যবহৃত চেয়ার , লাঠি , চিঠিপত্র , বই , পত্রিকা , অনুবাদ গ্রন্থ , আলোকচিত্র , অনুবাদিত ও চলচ্চিত্রায়িত কাহিনীর দুলর্ভ সম্ভার ৷এই গ্রামের মানুষের ইচ্ছা গ্রামের প্রবেশপথে একটি তোড়ণ , আলোকচিত্রের মাধ্যমে শরৎচন্দ্রের জীবন ও সাহিত্যকর্ম তুলে ধরার ব্যবস্থা করা , তাঁর লেখায় উল্লেখিত এই গ্রামের স্থান গুলিকে চিহ্নিত করে ফলক বসানোর ব্যবস্থা করা ৷ একসময়ের বাংলার প্রধান বন্দর সপ্তগ্রামের সাত গ্রাম বা মৌজার অন্যতম দেবানন্দপুরে সরস্বতী নদীর তীরে শরৎ উদ্যান নির্মিত হোক ৷যে নদীর তীরে “দত্তা” উপন্যাসের নায়ক -নায়িকা নরেন ও বিজয়ার প্রেম হয় ৷সবার প্রিয় অমর কথা শিল্পী শরৎ চাটুজ্যেকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম ৷

 

 

More from InternationalMore posts in International »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.