সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় / গোপাল দেবনাথ: কলকাতা, ১৪ মে, ২০২২। আমাদের দেশে একটি কথার বেশ প্রচলন আছে। যে কথাটি অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করেন। তা হলো ভারত অধ্যাত্মভূমি। কথাটি কিন্তু অর্ধসত্য। ইতিহাস বলে, প্রাচীন ভারতে ঈশ্বরবাদ ও নাস্তিক্যবাদ দুই মেরুতে অবস্থান করলেও সমান প্রাসঙ্গিক ছিল। অধ্যাত্মবাদ ও বস্তুবাদের নিরিখে দেশের সমাজতত্ত্ব প্রসারিত হয়ে এসেছে। ভারতীয় দর্শনে আস্তিক ও নাস্তিক উভয় ঐতিহ্যেরই বিস্তৃতি ছিল। ভারতীয় দর্শনে হিন্দু দর্শনে ছটি মতবাদ। ন্যায়, বৈশিষিক, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা ও বেদান্ত। বিরোধী নাস্তিক ধারাকে সমৃদ্ধ করেছে জৈন, বৌদ্ধ, আজীবক, অজান ও চার্বাক দর্শন। যে পাঁচটি দর্শন বেদকে অগ্রাহ্য করে।
বেদ পরবর্তী যুগে হিন্দু ধর্মের পাঁচটি ধারা, শৈব, শাক্ত,বৈষ্ণব, গণপত্য ও সৌর। বাংলায় চৈতন্য মহাপ্রভু গৌড়ীয় বৈষ্ণবের একটি ধারার প্রবর্তক। এসব প্রায় ৫৩২ বছর আগের কথা। বাংলার বুকে এই বৈষ্ণবীয় ধারাকে যিনি ভক্তিমার্গের উচ্চতায় পৌঁছে দেন শ্রী ল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী প্রভুপাদ। যাঁর জন্ম পুরীতে ১৮৭৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। আগামী ২০২৪ সালে শ্রী ল প্রভুপাদের ১৫০ তম জন্মদিবস উদযাপিত হবে। সেই উপলক্ষে উত্তর কলকাতার বনেদি অঞ্চল বাগবাজারের গৌড়ীয় মঠ তিনবছর ব্যাপী এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বিশ্বজুড়ে। গৌড়ীয় মঠের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী ল প্রভুপাদ তাঁর জীবদ্দশায় বিশ্বজুড়ে ৬৪ টি মঠ যেমন প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তেমন দেশের মানুষের শিক্ষার্থে শিক্ষালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছেন।
সমাজ জীবনের ঐশ্বরিক জ্ঞানে উদ্ভুত মানুষের চৈতন্যের বিকাশ ছিল তাঁর লক্ষ্য। কোলকাতার বাগ বাজার অঞ্চলে মঠ প্রতিষ্ঠা করে তিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদের বিস্তারে এক বৈপ্লবিক কার্য সাধন করেছেন। এখানেই তাঁর তিরোধান হয় ১৯৩৭ সালের ১জানুয়ারি। বৈষ্ণব ধর্মের ধারায় এখানে যেমন প্রভু জগন্নাথের স্নানযাত্রা, জন্মাষ্টমী, উর্জা ব্রত উৎসব, রামনবমী, দোলযাত্রা, রথযাত্রা, শ্রী অন্নকূট, শ্রী গোবর্ধন পুজো ও রাধাষ্টমী পালিত হয়, তেমন পালিত হয় ২ ১ দিনব্যাপী চন্দন যাত্রা ।
এই মুহুর্তে গত অক্ষয়তৃতীয়া থেকে সেই উৎসব চলছে। ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি জনস্বার্থে কুষ্ঠ হাসপাতাল, বৃদ্ধাশ্রম, বিনামূল্যে চিকিৎসা শিবির, বিনামূল্যে দরিদ্রসেবা,বিনামূল্যে চিকিৎসাকেন্দ্র, বস্ত্রদান,
প্রাকৃতিক দূর্যোগে সাহায্য, পেশাগত শিক্ষণ শিবির, প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে সামিল হওয়া এবং গো সেবা ও গোশালা পরিচালন ব্যবস্থা বছরভর করা হয়।
শ্রী ল প্রভুপাদের আসন্ন সার্ধশত বার্ষিক জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখতে তিনবছর ব্যাপী অনুসন্ধানের শুরু পুরীতে হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।অনুষ্ঠানের শুভসূচনা করেছিলেন রাষ্ট্রপতি । ২০২৪ এর অনুষ্ঠান সমাপ্তি হবে প্রতিষ্ঠাতার জন্মদিন ৬ ফেব্রুয়ারি। সে অনুষ্ঠানের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সহ বিশিষ্টরা যেমন হাজির থাকবেন, তেমন থাকবেন দেশের প্রধানমন্ত্রীও।
মূলত দেশের নারী সমাজ ও যুবসমাজকে উদ্ভূত্ত করতে এই তিনবছর ব্যাপী অনুষ্ঠানে বিশ্বজুড়ে হবে প্রদর্শনী, সেমিনার, ভক্তিমূলক অনুষ্ঠান। যা দেশের ১৯টি শহরে ও বিশ্বের ৯ টি দেশে সংগঠিত হবে। ব্যবহৃত হবে সংস্কৃত , ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা, ওড়িয়া , অসমীয়া ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষা। পরিবেশিত হবে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র, জীবনী, বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাস ও সমসাময়িক কালের বৈষ্ণব আন্দোলনের ডিজিটাল লেখ্য।
সরকারি উদ্যোগে ডাকটিকিট, মুদ্রা, শ্রী ল প্রভুপাদের মূর্তি উন্মোচন ও আদর্শ বৈষ্ণব গ্রাম নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইউনেস্কো ঐতিহ্যস্বীকৃতি ও সনাতন ধর্মের বিস্তৃতি সমন্বয়ের কাজ হবে। নতুন শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপিত হবে যেখানে বৈদিক ও বৈষ্ণব ধর্মের শিক্ষা দেওয়া হবে।নামকরণ হবে শ্রী ল প্রভুপাদ ইনস্টিটিউট অফ বেদিক অ্যান্ড বৈষ্ণব স্টাডিজ।
ইতিমধ্যেই বাগবাজার গৌড়ীয় মঠের প্রাঙ্গণে একটি বিশাল মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়েছে।যেখানে মঠের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী ল প্রভুপাদ ,গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের উদ্গাতা চৈতন্য মহাপ্রভু সম্পর্কে মডেল সহ্য তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। রয়েছে আনুসাঙ্গিক বহু আকর্ষণীয় তথ্য। গৌড়ীয় মিশনের প্রতিষ্ঠাতা ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী মহারাজের ১৫০ বছর জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে সমগ্র অনুষ্ঠান সূচি সংবাদমাধ্যমে জানাতে শুক্রবার সকালে বাগবাজারের মঠে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। বক্তব্য রাখেন মঠের সহ সম্পাদক হৃষিকেশ মহারাজ।
সুদূর লন্ডন থেকে ডিজিটাল মাধ্যমে বক্তব্য রাখেন, মঠের সভাপতি আচার্য ভক্তি সুন্দর সন্ন্যাসী গোস্বামী মহারাজ। সবশেষে ফ্লোরিডানিবাসী গৃহীভক্ত অধ্যাপক কৃষ্ণ অভিষেক ঘোষ জানান, বাঙালির ইতিহাস চর্চায় আলস্য আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। আমরা দেশের অনেক ঐতিহ্যের সাক্ষর হারিয়েছি। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধারা বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে যিনি জীবনভর ভক্তি আন্দোলন সমর্পিত প্রাণ ছিলেন, সেই শ্রী ল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী শ্রী ল প্রভুপাদের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। আগামী প্রজন্মের কাছে তাঁর ভক্তিমার্গের কথা পৌঁছে দিতে যা সহায়ক হবে। সাংবাদিক সম্মেলনে সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিলেন ভক্ত রঞ্জন সাহা।
Be First to Comment