জন্মদিনে স্মরণঃ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাবলু ভট্টাচার্য : রবীন্দ্র প্রতিভার আলোকস্পর্শ যখন ক্রমশ বিলীয়মান, যখন শরৎচন্দ্রের দিনও প্রায় শেষ পর্যায়ে, যখন দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে একটা অস্থিরতার স্পর্শ, এমনি এক যুগসন্ধিক্ষণে তারাশঙ্করের আবির্ভাব ঘটে বাংলা সাহিত্যে। তার লেখায় বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের মাটি ও মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবনচিত্র, স্বাধীনতা আন্দোলন, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ব্যক্তির মহিমা ও বিদ্রোহ, সামন্ততন্ত্র-ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্বে ধনতন্ত্রের বিজয় ইত্যাদি তার উপন্যাসের বিষয়বস্তু। সেখানে আরও আছে গ্রাম্যজীবনের ভাঙনের কথা, নগরজীবনের বিকাশের কথা। তার বাবা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা প্রভাবতী দেবী। তার পিতা বাড়িতে নিয়মিত রামায়ণ, মহাভারত, তন্ত্রশাস্ত্র প্রভৃতি পাঠ করতেন। তবে বাল্যকালে পিতাকে হারান তিনি। তারাশঙ্কর তার মা এবং বিধবা পিসিমার আদর-যত্নে লালিত-পালিত হন। অন্য আর দশটি সাধারণ বাঙালি সন্তানের মতো তার বেড়ে ওঠা। তাদের বাড়িতে নিয়মিত কালীপূজা হতো। তার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। তিনি ছেলেবেলায় মাদুলি, তাবিজসহ নানা সংস্কারের গণ্ডিতে বড় হয়ে ওঠেন। এই সততা, ধর্মভাব, ভক্তি ও ধর্মশাস্ত্রীয় বিশ্বাস তিনি পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকে।
লাভপুরের যাদবলাল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯১৬ সালে প্রথম বিভাগে এনট্রান্স পাস করে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা করেন তারাশঙ্কর। সে সময় মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। ওই আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯২১ সালে তিনি এক বছর কারা অন্তরীণ থাকেন। ফলে তার শিক্ষাজীবনের এখানেই সমাপ্তি ঘটে। ১৯৩২ সালে তিনি প্রথমবার শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে আসেন। ওই বছর তার প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ প্রকাশিত হয়। ১৯৪২-এর বীরভূম জেলা সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন এবং ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংগঠনের সভাপতি হন। তারাশঙ্করের প্রথম গল্প ‘রসকলি’ সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা কল্লোলে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া কালি কলম, বঙ্গশ্রী, প্রবাসী, শনিবারের চিঠি, পরিচয় প্রভৃতি প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়। তবে রাজনীতি থেকে তিনি একেবারে বিচ্ছিন্ন হননি। ১৯৫২ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৫ সালে ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে চীন ভ্রমণ করেন। ১৯৫৭ সালে তাসখন্দে এশীয় লেখক প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। এ সময় তিনি সফর করেন মস্কোও। অর্থের প্রয়োজনে শেষদিকে কিছুদিন দৈনিক সংবাদপত্রে কলাম লিখতেন। শেষ বয়সে কিছু ছবিও এঁকেছিলেন। তারাশঙ্করের উপন্যাস, গল্প ও নাটক নিয়ে চল্লিশটিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সত্যজিৎ রায়, তারাশঙ্করের ‘জলসাঘর’ এবং ‘অভিযান’ উপন্যাসের সফল চিত্ররূপ দিয়েছেন। তার যেসব রচনা চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছেঃ ‘জলসাঘর’, ‘অভিযান’, ‘অগ্রদানী’, ‘আগুন’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘উত্তরায়ণ’, ‘কবি’, ‘কান্না’, ‘কালিন্দী’, ‘গণদেবতা’, ‘জয়া’, ‘চাঁপাডাঙার বউ’, ‘ডাকহরকরা’, ‘দুই পুরুষ’, ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘ফরিয়াদ’, ‘বিচারক’, ‘বিপাশা’, ‘মঞ্জরী অপেরা’, ‘রাইকমল’, ‘শুকসারী’, ‘সন্দীপন পাঠশালা’, ‘সপ্তপদী’, ‘হার মানা হার’, ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’, ‘বেদেনী’ উল্লেখযোগ্য।
তিনি ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি গল্পের বই, ১২টি নাটক, চারটি প্রবন্ধের বই, চারটি আত্মজীবনী এবং দুটি ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কর্তৃক ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’, ‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার’, ‘পদ্মশ্রী’ ও ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত হন। এ ছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদেয় শরৎস্মৃতি পুরস্কার, জগত্তারিণী স্মৃতিপদক, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় দেহত্যাগ করেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৮ সালের আজকের দিনে (২৩ জুলাই) পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment