শু ভ জ ন্ম দি ন ত স লি মা না স রি ন
বাবলু ভট্টাচার্য : একজন উদীয়মান কবি হিসেবে আশির দশকে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন তসলিমা নাসরিন। তিনি তাঁর রচনা ও ভাষণের মাধ্যমে লিঙ্গসমতা, মুক্তচিন্তা, ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ ও মানবাধিকারের প্রচার করায় ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীদের রোষানলে পড়ে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করতে বাধ্য হন।
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস পাশ করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এনেসথেসিওলজি বিভাগে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তেরো বছর বয়স থেকে তসলিমার লেখালিখি শুরু। ১৯৮৬ সালে ‘শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা’ নামক তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালে ‘নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে’ ও ১৯৯০ সালে ‘আমার কিছু যায় আসে না’ কাব্যগ্রন্থগুলি প্রকাশিত হয়।
এই সময় ‘নির্বাচিত কলাম’ নামক তার বিখ্যাত প্রবন্ধসঙ্কলন প্রকাশিত হয়— যার জন্য ১৯৯২ সালে তসলিমা নাসরিন ‘আনন্দ’ পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৯৩ সালের মধ্যে ‘অতলে অন্তরীণ’, ‘বালিকার গোল্লাছুট’ ও ‘বেহুলা একা ভাসিয়েছিল ভেলা’ নামক আরও তিনটি কাব্যগ্রন্থ; ‘যাবো না কেন? যাব’ ও ‘নষ্ট মেয়ের নষ্ট গল্প’ নামক আরও দুইটি প্রবন্ধসঙ্কলন এবং ‘অপরপক্ষ’, ‘শোধ’, ‘নিমন্ত্রণ’ ও ‘ফেরা’ নামক চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
১৯৯৩ সালে তাঁর পঞ্চম উপন্যাস ‘লজ্জা’ প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে বাংলাদেশের মুসলিমদের দ্বারা একটি সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের ওপর অত্যাচারের বর্ণনা করা হয়েছে। উপন্যাসটি প্রকাশের পর মুসলিম মৌলবাদীরা তসলিমার উপর শারীরিক ভাবে নিগ্রহ করে ও তাঁর এই উপন্যাস নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবী জানায়।
তসলিমা নাসরিনের সাতটি আত্মজীবনী গ্রন্থের অধিকাংশ বাংলাদেশ ও ভারত সরকার দ্বারা নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষিত হয়। ‘আমার মেয়েবেলা’ নামক তার প্রথম আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে ইসলামের প্রতি বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষিত হলেও ২০০০ সালে এই বইয়ের জন্য তসলিমা দ্বিতীয়বার ‘আনন্দ’ পুরস্কার লাভ করেন।
২০০২ সালে তাঁর দ্বিতীয় আত্মজীবনী ‘উতাল হাওয়া’ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষিত হয়। ২০০৩ সালে ‘ক’ নামক তাঁর তৃতীয় আত্মজীবনী বাংলাদেশ উচ্চ আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে এই বইটি ‘দ্বিখন্ডিত’ নামে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ভারতীয় মুসলিমদের একাংশের চাপে নত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে বইটিকে নিষিদ্ধ করা হয়।
২০০৪ সালে ‘সেই সব অন্ধকার’ নামক তাঁর চতুর্থ আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
১৯৯৪ সালের মে মাসে ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে তিনি ইসলামি ধর্মীয় আইন শরিয়া অবলুপ্তির মাধ্যমে কুরআন সংশোধনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এর ফলে ইসলামি মৌলবাদীরা তাঁর ফাঁসির দাবী জানিয়ে তাঁকে ইসলামের অবমাননাকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দালাল রূপে অভিহিত করে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে জনগণের ধর্মীয় ভাবনাকে আঘাত করার অভিযোগে মামলা রুজু করা হয় এবং জামিন-অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তসলিমা পালিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর তিনি ১৯৯৪ সালে সুইডেনে ও পরবর্তী এক বছর জার্মানিতে বসবাস করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি সুইডেনের নাগরিকত্ব লাভ করেন।
২০০০ সালের মার্চ মাসে তিনি ‘শোধ’ নামক তাঁর একটি উপন্যাসের মারাঠি ভাষায় অনুবাদকর্মের প্রচারে মুম্বই শহরে পৌছনোর সময় মুসলিম মৌলবাদীরা তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার হুমকি দেয়।
২০০৬ সালে টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম সৈয়দ নূরুর রহমান বরকতি নাসরিনের মুখে কালিলেপন করলে পুরস্কৃত করার কথা ঘোষণা করে। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল বোর্ড নামক একটি সংগঠন তাঁর মুন্ডচ্ছেদের জন্য পাঁচ লাখ টাকা ঘোষণা করে।
এই বছর ৯ আগস্ট তিনি ‘শোধ’ উপন্যাসের তেলুগু ভাষায় অনুবাদকর্মের প্রচারে হায়দ্রাবাদ শহরে গেলে অল ইন্ডিয়া মজলিস-এ-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন নামক একটি রাজনৈতিক দলের প্ররোচনায় উত্তেজিত জনতা তাঁকে আক্রমণ করে।
১৭ আগস্ট কলকাতা শহরের মুসলিম নেতারা তসলিমাকে হত্যা করার জন্য বিপুল অর্থ পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। ২১ নভেম্বর অল ইন্ডিয়া মাইনোরিটি ফোরাম নামক একটি ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠী কলকাতা শহরে তাণ্ডব শুরু করলে সেনাবাহিনীকে আইন ও শান্তিরক্ষার জন্য মোতায়েন করা হয়। এই দাঙ্গার পর তসলিমা নাসরিনকে কলকাতা থেকে জয়পুর হয়ে নতুন দিল্লি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরবর্তী সাত মাস তাঁকে একটি অজ্ঞাত স্থানে গৃহবন্দী করে রাখা হয়।
২০০৮ সালে তাঁকে ‘সিমন দ্য বিভোয়ার’ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হলেও তিনি ভারতে প্রবেশে অনুমতি না পেয়ে পুরস্কার নিতে অসম্মত হন। এই সময় তিনি ‘নেই কিছু নেই’ নামক তাঁর আত্মজীবনীর ষষ্ঠ ভাগ প্রকাশ বাতিল করেন ও কলকাতার দাঙ্গার জন্য দায়ী ‘দ্বিখণ্ডিত’ নামক তাঁর বিতর্কিত বইটির কিছু অংশ অপসারণ করতে বাধ্য হন।
২০০৮ সালের ১৯ মার্চ তসলিমা ভারত ছাড়তে বাধ্য হন।
তসলিমা তাঁর উদার ও মুক্তচিন্তার মতবাদ প্রকাশ করায় দেশ-বিদেশ থেকে একগুচ্ছ পুরস্কার ও সম্মাননা গ্রহণ করেছেন। সেগুলো হলো— আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯২, ২০০০), নাট্যসভা পুরস্কার (বাংলাদেশ, ১৯৯২), ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট কর্তৃক শাখারভ পুরস্কার (১৯৯৪), ফ্রান্স সরকার প্রদত্ত মানবাধিকার পুরস্কার (১৯৯৪), সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল পেন কর্তৃক কার্ট টুকোলস্কি পুরস্কার (১৯৯৪), যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ কর্তৃক হেলম্যান-হ্যামেট গ্রান্ট সম্মাননা (১৯৯৪), নরওয়েভিত্তিক হিউম্যান-এটিস্ক ফরবান্ড কর্তৃক মানবতাবাদী পুরস্কার (১৯৯৪)।
তসলিমা নাসরিন ১৯৬২ সালের আজকের দিনে (২৫ আগস্ট) বাংলাদেশের ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment