স্মরণঃ তপন সিনহা
বাবলু ভট্টাচার্য : তপন সিনহাকে বাংলা তথা ভারতীয় ছবির একটা বিশেষ ঘরানার জনক বলা যায়। সেটা হল ‘মিডল অব দ্য রোড’ ঘরানা। তার ছবিতে শিল্প আর জনপ্রিয় ঘরানার সিনেমার একটা আশ্চর্য মিশেল ঘটেছিল। একটা সুন্দর গল্পকে সুন্দরতর চিত্রনাট্যে সাজিয়ে সুন্দরতম ভাবে চলচ্চিত্রায়িত করার যে ধারা তার ছবিতে দেখা যায়, ভারতবর্ষের খুব কম পরিচালক এতটা নিখুঁতভাবে সেটা করতে পেরেছেন।
প্রায় দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের কেরিয়ারে তিনি চল্লিশটার মতো ছবি বানিয়েছিলেন। তার প্রথম দুটি ছবি ‘অঙ্কুশ’ এবং ‘উপহার’ বাণিজ্যিক ভাবে ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৫৬ সালে ‘টনসিল’ নামক একটা ছবি বানান। তারপর থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একই সাথে দেশে বিদেশের প্রচুর পুরস্কার ও বাণিজ্যিক সাফল্য তিনি পেয়েছিলেন।
তার চতুর্থ ছবি ‘কাবুলিওয়ালা’ বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিল। এছাড়া ছবিটি একইসঙ্গে শ্রেষ্ঠ ভারতীয় ছবি ও শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিল। তবে ১৯৬১ সালে বানানো তাঁর নবম ছবি ‘ঝিন্দের বন্দী’ থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে তিনি তার শ্রেষ্ঠ ছবিগুলি বানিয়েছিলেন। শিল্পকর্ম হিসেবে প্রতিটি ছবিই ভারতীয় সিনেমার মাইলফলক হওয়ার দাবি রাখে।

তিনি বরাবরই তার ছবিতে একা মানুষের লড়াইকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। গল্প উনি বলতেন ঠিকই। সেই সময় বাংলা ছবিতে এটাই মন দিয়ে প্র্যাকটিস করা হত। উনি ছাড়াও অজয় কর, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, অসিত সেন, অগ্রদূত গোষ্ঠী, যাত্রিক গোষ্ঠীর প্রভৃতি পরিচালকরা ছবির পর ছবি জুড়ে পর্দায় একটা নিখুঁত আখ্যানকে দর্শকের সামনে তুলে ধরার কাজে এক্সপার্টাইজ অর্জন করেছিলেন। ওরা বিশ্বাস করতেন যে বাঙালি দর্শক আসলে গল্পই দেখতে চায়। হাজার বছর ধরে শুধু গল্প শোনার আশাতেই বাঙালি বসে আছে।
তপন সিনহা ১৯২৪ সালের ২ অক্টোবর বীরভূম জেলার মুরারই থানার জাজিগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন ত্রিদিবেশ সিনহা এবং মা প্রমিলা সিনহা।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতোকত্তর করার পর তপন সিনহা ১৯৪৬ সালে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে সহকারী শব্দগ্রহণকারী হিসাবে যোগদান করেন।

তপন সিনহা ১৯৫০-এর দশকে লন্ডনে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্র- নির্মাণ শিখতে। লন্ডনে পৌঁছে তিনি পাইনউড স্টুডিওর পরিচালক মাইক্রোথের সাথে যোগাযোগ করেন। তার সাহায্যের মাধ্যমে, তিনি তার প্রথম কার্যভারটি অর্জন করতে সক্ষম হন। তিনি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পরিচালক চার্লস ক্রিটনের ইউনিটে কাজ করতে শুরু করেন। সিনহা শব্দ রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে শুরু করলেও ধীরে ধীরে তিনি পরিচালনায় সরে এসেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর জীবনের বড়ো প্রেরণা। রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে বেশ কয়েকটি ছবি বানিয়েছিলেন – ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘অতিথি’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’। বাংলা ও হিন্দি ভাষায় তার ‘লৌহ কপাট’, ‘ক্ষণিকের অতিথি’, ‘ঝিন্দের বন্দি’, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’, ‘হাটেবাজারে’, ‘সাগিনা মাহাতো’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, ‘হুইলচেয়ার’, ‘নির্জন সৈকত’, ‘জতুগৃহ’, ‘আরোহী’, ‘সফেদ হাথি’, ‘জিন্দগি জিন্দগি’, ‘এক ডক্টর কি মৌত’-এর মতো ছবিগুলি ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের সম্পদ।
দেশ-বিদেশের নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তপন সিংহ। শ্রেষ্ঠ ভারতীয় চলচ্চিত্রের জন্য তিনি অনেকবার জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছেন। ২০০৬ সালে তাঁকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রদান করা হয়।

তপন সিনহা ২০০৯ সালের আজকের দিনে (১৫ জানুয়ারি) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।


Be First to Comment