শ্ৰদ্ধা ও স্মরণে বিশিষ্ট অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী। কলকাতা, ১৭, ডিসেম্বর, ২০২০।
শেখর দা । শেখর অধিকারী ।
টালিগঞ্জ ফিল্ম/ টিভি ইন্ডাস্ট্রির এই মুহুর্তের জ্যেষ্ঠতম হেয়ার স্টাইলিস্ট.. আর নেই। ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই শেষ হলো কাল।
১৯৮৬/৮৭ হবে। আমি তখন খুব ছোট। কলকাতার নাটোর রাজবাড়ীতে শুটিং হচ্ছে টিভি সিরিয়াল ‘সেই সময়’ এর। পরিচালক জোছন দস্তিদার। ক্যামেরার পিছনে সৌমেন্দু রায় (সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরাম্যান)। আমার দিদি বিদীপ্তা চক্রবর্তী অভিনয় করতো একটি ছোট চরিত্রে। শুটিং দেখতে গেলাম একদিন। সেই প্রথম শুটিং দেখা। ক্যামেরার সামনে বাইজীর বেশে মুকু দি খেয়ালী দস্তিদার। গানে লিপ দিচ্ছে আর সঙ্গে কিছু নাচের ভঙ্গিমা/মুদ্রা ইত্যাদি। ক্যামেরার পিছন থেকে সেই মুদ্রা গুলো দেখিয়ে দিচ্ছেন এক ভদ্রলোক। ভাবলাম তিনি নিশ্চয়ই নাচের শিক্ষক। পরে জানলাম, না। তিনি এই ইউনিটের হেয়ার ড্রেসার। ভালো গান করেন। নাচেন ও সুন্দর। তাই শুটিংয়ে সাহায্য করছেন। সেই প্রথম শেখর দা কে দেখা। আমাকে ডাকতেন পুঁচকি বলে। সত্যিই তো। পুঁচকি বয়স থেকেই তো দেখছেন আমাকে… আমাদের তিন বোনকেই। পরে অবশ্য “টুম্পা” হয়ে যাই।
বরাবরই বড়ো আর্টিস্ট দের চুল বাঁধতেন শেখর দা। সিনিয়ার রা খুবই ভরসা করতেন ওঁকে। নতুন, পুরনো, পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সাধারণ বা ফ্যাশনেবল, যে কোনো চরিত্রের চুল বাঁধতেন অসামান্য দক্ষতায়। শুধু চুল কেন? মেকআপের খুঁটিনাটি, কোন চরিত্রের চোখ কেমন হবে, ঠোঁট কেমন হবে, সব শেখর দার নখদর্পণে। বহুদিন ধরে পেশাদার রঙ্গালয়ের গ্রীন রুম সামলাবার অভিজ্ঞতা ছিল বলেই বোধ হয়। তাছাড়া নিজের inherent quality ও ছিলো এই বিষয়ে। পরে যখন আমি ও একটু বড়ো হই, (বড়ো শিল্পী নয়, বয়সে বড়ো), তখন আস্তে আস্তে সুযোগ পাই শেখর দার চিরুনি মাথায় লাগাবার। শেখর দা ইউনিটে থাকা মানে মহিলা শিল্পীদের আর কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে। চরিত্রানুযায়ী শাড়ি পরানো, পিন করা, গয়না পরা, রাস্তায় শুট করলে টয়লেট যাওয়া (তখন মেকআপ ভ্যান থাকতো না) সব ব্যাপারেই ঠিকানা শেখর দা। চেহারা যদিও পুরুষের। তবু ভরসা পেতাম ষোলো আনা। শেখর দার মনের খবর সে ভাবে নেওয়া হয়নি। অনেক বড়ো তো। ভয় লাগতো। একটু সংকোচ ও। তাছাড়া সেই সময়ে লিঙ্গ পছন্দ নিয়ে খুব একটা খুল্লাম খুল্লা আলোচনা হতো ও না । নিজের আত্মীয় দের কথা কখনো বলতেন না। বলতেন শুধু শেফালি দির কথা। Legendary Caberret dancer Ms. Shephali…. শেখর দার দিদি । রক্তের সম্পর্ক ছিলো না যদিও কোনো। তবু শেখর দাই বরাবর ছিলেন মিস্ শেফালির অভিভাবক, ভাই ও একমাত্র confidante ।
কত কাজ করেছি, কত গল্প, কত কি শেখা শেখর দার কাছে। আজ সব শেষ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবে শেখর দার “body”. পঞ্চভুতে বিলীন হয়ে যাবে শেখর দা। আমরা কি মনে রাখবো তাঁকে? কি জানি !!! কলাকুশলী দের এমনি ও মনে রাখে না কেউ। সিনেমার শেষে কলাকুশলী দের নাম দেখার ভদ্রতা আমাদের দেশে প্রায় কেউই দেখান না। সিনেমা হল গুলো ও আলো জ্বালিয়ে দেয় সিনেমা শেষ হলেই। যাতে তাড়াতাড়ি প্রেক্ষাগৃহ খালি হলে পরের শো টা শুরু করা যায় আর কি। টিভি তে তো আজকাল পরিচালক, অভিনেতা, কলাকুশলী কারুর নাম ই দেখানো হয়না। ওই..একটু সময় বাঁচে আর কি। OTT তে আবার title skip করা যায়। ওই….সময় বাঁচানোর ফন্দি। আমাদের সময়ের অনেক দাম তো। কৃতজ্ঞতা জানানোর ও মোটে সময় নেই আমাদের হাতে। শেখর দা কে, শেখর দা দের মনে রাখার সময় পাবো কি আমরা ??
কি জানি !!!! দেখি….

Be First to Comment