Press "Enter" to skip to content

টাটা মেমোরিয়াল সেন্টারে স্টেমসেল চিকিৎসায় সুস্থ রোগীদের সঙ্গে মিলিত হলেন ভিন রাজ্যের স্টেমসেল দাতারা। এই আবেগঘন পরিবেশের আয়োজক দাত্রী সমাজসেবী সংস্থা…..।

Spread the love

শ্রীজিৎ চট্টরাজ/গোপাল দেবনাথ : কলকাতা, ২৯ মার্চ ২০২২।  এই মুহূর্তে ইউক্রেনকে নিয়ে প্রায় সম্মুখ সমরে আমেরিকা ও রাশিয়া। রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রভাব বজায় রাখার খেলায় ভুক্তভোগী প্রত্যক্ষভাবে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ। মানব নিধন যজ্ঞ চলছে সেখানে। পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন রাশিয়া ও আমেরিকার সাধারণ মানুষ। অথচ বিজ্ঞানীদের এক অবিস্মরণীয় আবিষ্কার আজ মানব জীবনের নতুন গতি আনার ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক যুগের দিশা দেখিয়েছে। অমানবিক বিশ্বে এই মানবিক প্রয়াস বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায় বৈকি। ১৯০৮সালে রাশিয়ার বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ম্যাক্সিমভ পরীক্ষা নিরীক্ষায় সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, মানব শরীরের রোগ নির্মূলে যেসব ওষুধ প্রয়োগ হয় বা শল্য চিকিৎসা করা হয়, তাতে ১০০ শতাংশ রোগ নির্মূল হয় না। দরকার বিকল্প পদ্ধতি। তিনি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, মানব শরীরের স্টেম সেল বাংলায় যাকে বলে সস্য কোষ দিয়েই রোগ নির্মূল সম্ভব।যাকে বলে গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো।

এরপর চলতে থাকে বিশ্বজুড়ে গবেষণা। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন ব্রিটেনের বিজ্ঞানী জন গর্ডন । তিনি রাশিয়ার বিজ্ঞানীর আবিষ্কৃত তত্ত্ব থেকে প্রমাণ করেন দেহকোষ থেকে স্টেমসেল বা সস্য কোষ কিভাবে তৈরি সম্ভব। তবে এই প্রক্রিয়াটি কঠিন। অসাধ্য সাধন করেন জাপানের বিজ্ঞানী শিনিয়া ইয়ামানাকা। তিনি হাতে কলমে প্রমাণ করেন স্টেমসেল বা সস্য কোষ নির্মাণ খুবই সহজ। মানব দেহের চারটি জিন পরিবর্তন করেই আকাঙ্খিত স্টেমসেল নির্মাণ সম্ভব। এই কিংবদন্তি দুই বিজ্ঞানীকে তাই নোবেল কমিটি ২০১২ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে অসাধারণ আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে।

বিশ্বজুড়ে স্টেমসেল পদ্ধতি প্রয়োগ করে বহু কঠিন রোগের চিকিৎসা শুরু হয়ে গেছে। সাফল্যের হারও সন্তোষজনক। ভারতও এই চিকিৎসায় রয়েছে প্রথম সারিতে। শুধু তাই নয়। স্টেমসেল চিকিৎসা খরচও বিশ্বের উন্নত দেশের তুলনায় ভারতে প্রায় অর্ধেক। তাই দেশের নাগরিকরাই শুধু নয়, প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা সহ বহুদেশের মানুষ ভারত তথা কলকাতায় আসছেন আরোগ্যলাভের আশায়। কলকাতায় ক্যান্সার চিকিৎসায় এক অগ্রণী কেন্দ্র টাটা মেমোরিয়াল সেন্টার। নিউটাউনের এই চিকিৎসাকেন্দ্রে স্টেমসেল পদ্ধতিতে ক্যান্সার চিকিৎসায় রোগীকে রোগমুক্ত করা হচ্ছে।
সোমবার চেন্নাইয়ের একটি অলাভজনক সমাজসেবী সংস্থা দাত্রী সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে টাটা মেমোরিয়াল সেন্টারে। স্টেমসেল পদ্ধতিতে সুস্থ হওয়া দুই ব্লাড ক্যান্সারের কিশোর কিশোরী হাজির ছিলেন অভিভাবকদের সঙ্গে। উপস্থিত ছিলেন চেন্নাই থেকে আগত স্টেমসেল দাতা প্রশান্ত ভেঙ্কটারমণ ও কেরালার দাতা নিজামউদ্দিন। নিজামউদ্দিন নিজের স্টেমসেল দান করে জীবন দিয়েছেন বাংলার ব্রাহ্মণ সন্তান কিশোর চন্দ্রনাথ ব্যানার্জিকে। প্রশান্ত ওড়িশা থেকে আগত আলিভা রাউতকে দান করেন স্টেমসেল। চেন্নাইয়ের দাতা প্রশান্ত ও কেরালার নিজামউদ্দিন যে দুজন কিশোর কিশোরীকে নতুন জীবন দিয়েছেন তাঁদের মুখোমুখি হয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সদ্য জীবন ফিরে পাওয়া সন্তানদের অভিভাবকদের চোখেও চিকচিক করছিল কৃতজ্ঞতার অশ্রু। দুই অভিভাবকের দুই সন্তানই তাঁদের একমাত্র সন্তান।

টাটা মেডিক্যাল সেন্টারের ডিরেক্টর মামেন চাণ্ডী বলেন, এই স্টেমসেল পদ্ধতিতে রোগ নিরাময়ের এক মহান কর্মযজ্ঞ ২০০৯ থেকে করে আসছে দাত্রী সমাজসেবী সংস্থা। আমরা টাটা মেডিক্যাল সেন্টারের পক্ষ থেকে এঁদের সহযোগী হতে পেরে গর্বিত অনুভব করছি। ভারতে সর্ববৃহৎ সংস্থা দাত্রীর কাছে স্টেমসেল দাতাদের এক তালিকা আছে। আমাদের কাছে এমন অনেক রোগী রোজ আসেন যাঁদের চিকিৎসার জন্য স্টেমসেল দাতা প্রয়োজন সেই দাতার খোঁজ দিয়ে এক মানবিক ঐতিহ্যের ধারা বজায় রেখে চলেছে দাত্রী। অনুষ্ঠানে স্টেমসেল দাতা ও রোগীদের যেসব চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা হয়েছে তাঁদের সম্মানিত করা হয় শংসাপত্র দিয়ে।

প্রতিবেদকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে দাত্রী সংস্থার পক্ষে সুমতি মিশ্র জানালেন, রোগীর জীবনদানে রক্তদান করে বহু মানুষ সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিচয় দেন। স্টেমসেলও এমন এক পদার্থ যা রক্ত থেকেই সংগৃহীত হয়। প্রথম দিকে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সুস্থ মানুষের কোমরের হাড় থেকে বোনম্যারোর রক্ত সংগৃহীত হতো। কিন্তু মানুষের মধ্যে এক ভীতির কারণে এখন যেভাবে রক্ত পরীক্ষার জন্য রক্ত সংগ্রহ হয়, সেই পদ্ধতিতেই স্টেমসেল সংগ্রহ করা হয়। আমরা করোনা পরিস্থিতিতে শুনেছি, রক্তের প্লেটলেট কমে যায়। তখন সংগৃহীত রক্ত থেকে প্লেটলেট সংগ্রহ করে করোনা রোগীর চিকিৎসা হয়েছে। স্টেমসেল সেই একই পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা হয়।

সুমতি মিশ্র আরও জানালেন, আই সি সি আর এর সমীক্ষা বলছে দেশে প্রতিদিন ১০হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মাচ্ছে এবং প্রতি ছ মিনিটে একজন ব্লাড ক্যান্সার রোগ নিয়ে শিশু জন্মাচ্ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রোগী অনুপাতে দাতার সংখ্যা অনেক কম। স্টেমসেল ব্যাংকে বহু সংখ্যক মানুষ যদি নিজের স্টেমসেল দান করেন, তাহলে লক্ষ রোগীর জীবন দান করা যেতে পারে। দরকার সঠিক প্রচার ও সচেতনা। সবচেয়ে বড় কথা, স্টেমসেল এমনই এক রক্তের মধ্যকার বস্তু, কোনও পরিবারের কারও প্রয়োজন হলে সেই রোগীর মা কিম্বা বাবার স্টেমসেল মিলে যেতে পারে সর্বাধিক ৫০শতাংশ। কিন্তু প্রয়োজন ১০০শতাংশ মিল। সেক্ষেত্রে দাত্রী’র মত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দাতা তালিকাই ভরসা। এই মুহূর্তে দাত্রী’র তালিকায় আছে ৪ লক্ষ৬৮ হাজার ৯৯৪ জন দাতা। বিশ্বে এই দাতার সংখ্যা ৩৩ মিলিয়ন। প্রয়োজনের তুলনায় যা অনেক কম। ভারতের মতো জনবহুল দেশে যেকোন সুস্থ ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষ স্টেমসেল দান করতে পারেন বিনা দ্বিধায়। শরীরের কোনও ক্ষতি হয় না। সাধারণত স্টেমসেল পদ্ধতির প্রয়োগের পর ১০০ দিনের মধ্যে দুরারোগ্য রোগী সুস্থ হয়ে যান। আমাদের দেশে এখন শুধু বিভিন্ন ধরনের ব্লাড ক্যান্সার রোগে এই স্টেমসেল পদ্ধতির প্রয়োগ হয়।

বাকি দুরারোগ্য ব্যাধির ক্ষেত্রে স্টেমসেল পদ্ধতি প্রয়োগের গবেষণা চলছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ এমন সিদ্ধান্ত চিকিৎসকেরা নিলে তবেই দাতা ও গ্রহীতা রাজি থাকলে পরস্পর পরিচিত হতে পারেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দাতা নিজের পরিচয় গোপন রাখতে চান। দাত্রী সংগঠন বাংলার মানবিক নাগরিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে আবেদন রেখেছেন, তাঁরা যদি এই মহান কর্মযজ্ঞে প্রচারের কাজে দাত্রী’র সঙ্গে যুক্ত হতে চান, তাঁদের স্বাগত জানানো হবে। আপাতত সংগঠন চেন্নাই থেকেই ভারতব্যাপী কর্মযজ্ঞে ব্রতী হয়েছে।

More from HealthMore posts in Health »
More from InternationalMore posts in International »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.