জন্মদিনে স্মরণঃ জাঁ পল সার্ত্রে
বাবলু ভট্টাচার্য : অস্তিত্ববাদ দর্শনের জনক হিসেবে ধরা হয় তাঁকে। তাঁর দার্শনিক প্রতিফলন, সাহিত্যিক সৃজনশীলতা, অক্লান্ত সাধনা এবং সক্রিয় রাজনৈতিক অঙ্গীকার অর্জন তাঁকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়। তিনি অস্তিত্ববাদ ও অবভাসবাদী দর্শনের অন্যতম প্রধান দার্শনিক। পরবর্তীকালের সমাজবিজ্ঞান, সমালোচনাতত্ত্ব ও উত্তর-উপনিবেশবাদতত্ত্বে তার বেশ প্রভাব রয়েছে।
তিনি তাঁর বাবা জাঁ ব্যাবিস্টে সার্ত্রে ও মা অ্যান মারি। অ্যান মারি ছিলেন ১৯৫২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী আলবার্ট সোয়াইৎজারের ভাইয়ের মেয়ে। ২ বছর বয়সে সার্ত্রে বাবাকে হারান। শৈশব কেটেছে মা ও দাদা চার্লস সোয়াইৎজারের কাছে। দাদার কাছে তিনি গণিত ও ধ্রুপদী সাহিত্য পড়েন।
জ্যঁ পল সার্ত্রের জীবন ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতির তেমন তোয়াক্কা করেননি। যখন যা সঠিক বলে মনে করেছেন তাই-ই অকপটে ব্যক্ত করেছেন।
জা পল সার্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় প্যারিস শহরের লিসে দ্য ল’ রোসেইয়া এবং লিসে লেগ্রাঁদ স্কুলে। এরপর দর্শনশাস্ত্র পড়ার জন্য ভর্তি হন ইকোলে নরমালে সুপিরিউর কোর্সে। সাফল্যের সাথে কোর্স সমাপ্ত করে হাভ্র, লাঁও এবং নয়নিতে উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
১৯২০ সালে হেনরি বাঁগসোর ‘টাইম অ্যান্ড ফ্রি উইল : অ্যান এসে অন দ্য ইমেডিয়েট ডাটা অব কনশাসনেস’ পড়েন। যা তাঁকে দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। পরে ব্যাপকভাবে কান্ট, হেগেল এবং হেইডেগারের লেখা পড়েন। এ ছাড়া আলেকজান্দ্রে কোজিবের সাপ্তাহিক সেমিনারে নিয়মিত হাজিরা দিতেন।
প্যারিসের খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একোলি নরমাল সুপেরিয়ের থেকে দর্শনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করেন। এছাড়া ফ্রান্স ও বিশ্বের খ্যাতনামা একাধিক দার্শনিকের সংস্পর্শেও ক্রমে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে থাকেন সার্ত্রে।
১৯২৯ সালে নরমাল সুপিরিওরে পরিচয় ঘটে আলোচিত লেখিকা সিমন দ্য বোভোঁয়ারের সঙ্গে। তাঁদের রোমান্টিক সম্পর্ক শেষ জীবন পর্যন্ত অটুট ছিল।
১৯২৯ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করেন। এখানে কিছু সময় মেটেরোলজিস্ট হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৩১ সালে দর্শনের প্রফেসর হিসেবে লা হার্ভেতে যোগ দেন। ১৯৩৫ সালে প্যারিসের লিসে কঁদরসে শিক্ষকতা শুরু করেন। এ সময় সমকালীন ইউরোপিয়ান দার্শনিকদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে উঠে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তিনি ফরাসি সৈন্যবাহিনীতে ‘মেটেরোলজিস্ট’ হিসেবে কাজ করেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে নাজিদের হাতে বন্দিও হন। যুদ্ধবন্দি অবস্থায় লেখেন প্রথম নাটক। তবে বছরখানেক পর তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু জীবন ও দর্শনে গভীর প্রভাব ফেলে এ যুদ্ধ। প্যারিসে ফিরে স্বাধিকার আন্দোলনে যুক্ত একটি গোপন দলে যোগ দেন।
১৯৪৪ সালে প্যারিসে যুদ্ধাবসানের সময় জোরদার লেখনী দিয়ে ক্রমেই পরিচিতি পেতে থাকেন। এরপর আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন। এ সব বক্তৃতা প্রশংসিত হয় এবং তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী হলেও কখনও পার্টিতে যোগ দেননি।
তার সব বই ফরাসি ভাষায় লেখা। এগুলো বিশ্বের প্রায় সবকটি প্রধান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৪৩ সালে বিখ্যাত বই ‘বিং এন্ড নাথিংনেস’ প্রকাশিত হয়। এরপর একে একে প্রকাশ হয় ‘এক্সিটেনশিয়ালিজম এন্ড হিউম্যানিজম’ (৪৬), ‘সার্চ ফর আ মেথড’ (৫৭) ও ‘ক্রিটিক অব ডায়ালেকটিক্যাল রিজন’ (৬০)।
দর্শনের অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছেন- ‘ইমেজিনেশন : এ সাইকোলজিক্যাল ক্রিটিক’, ‘দ্য ট্রানসেন্ডেন্স অব দ্য ইগো’, ‘স্কেচ ফর এ থিওরি অব দ্য ইমোশন্স’, ‘দ্য ইমেজিনারি’, ‘অ্যান্টি সেমাইট অ্যান্ড জিউ’, ‘বদলেয়ার’, সিচুয়েশন সিরিজ (ওয়ান টু টেন), ‘ব্ল্যাক অরফিউজ’, ‘দ্য হেনরি মার্টিন অ্যাফেয়ার’ প্রভৃতি।
১৯৭১ সালে আত্মজীবনী ‘ফ্লরেয়ার’ প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য লেখা উপন্যাস, নাটক ও চিত্রনাট্যের মধ্যে রয়েছে- ‘লা নাজি’, ‘দ্য মুর’, ‘ব্যারিওনা’ (প্রথম নাটক), ‘দ্য ফ্লাইজ’, ‘নো এক্সিট’, ‘দ্য এজ অব রিজন’, ‘দ্য রেসপেক্টফুল প্রস্টিটিউট’, ‘দ্য ভিক্টরস’, ‘দ্য চিপস আর ডাউন’, ‘ইন দ্য ম্যাস’, ‘ডার্টি হ্যান্ডস’, ‘ট্রাবলড পি’, ‘দ্য ডেভিল অ্যান্ড দ্য গুড লর্ড’, ‘কিন’, ‘দ্য কনডেমড অব আলটোনা’, দ্য ট্রোজান ওম্যান’, ‘দ্য ফ্রড সিনারিও’ প্রভৃতি।
এ ছাড়া আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘সার্ত্রে বাই হিমসেল্ফ’, ‘দ্য ওয়ার্ডস’, ‘উইটনেস টু মাই লাইফ কোয়াইট মোমেন্টস ইন এ ওয়ার’ এবং ‘ওয়ার ডায়েরি’স’। সার্ত্রে ও বোভোঁয়ার মিলে ‘লেস ভেজপস মোদারনেস’ নামক জনপ্রিয় মাসিক পত্রিকা বের করতেন।
১৯৬৪ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় এবং তিনি তা প্রত্যাখান করেন। একজন লেখকের কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত নয়- এ যুক্তিতে পুরস্কারটি প্রত্যাখান করেন তিনি। ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি এ কাজ করেন। শুধু নোবেল বলেই না, ১৯৪৫ সালে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ফরাসি সরকারের সর্বোচ্চ সম্মাননা লেজিওঁ দনর ও প্রত্যাখান করেন ।
১৯৬৪ সালের ২২ অক্টোবর নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। এর আগে ১৪ অক্টোবর নোবেল কমিটি বরাবর সার্ত্রে একটি চিঠি লেখেন যেন তার নাম মনোনয়নের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। তিনি চিঠিতে নোবেল কমিটিকে সতর্ক করে দেন এই বলে– যদি তাকে পুরস্কার দেয়াও হয় তা তিনি গ্রহণ করবেন না ।
১৯৮০ সালের ১৫ এপ্রিল ফ্রান্সের প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন জাঁ পল সার্ত্রে।
জাঁ পল সার্ত্রে ১৯০৫ সালের আজকের দিনে (২১ জুন) প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment