জন্মদিনে স্মরণঃ জী ব না ন ন্দ দা শ
“আমি কবি, সেই কবি-
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি
ঝরাপালকের ছবি…”
[জীবনানন্দ দাশ]
বাবলু ভট্টাচার্য : কিছুকালের জন্য তিনি এসেছিলেন এই পৃথিবীতে। বাংলার রূপ দেখে পৃথিবীর রূপ খুঁজতে চাননি তিনি। বাংলার ঘাস, বাংলার বাতাস, বাংলার পাখি, বাংলার শাখী, বাংলার পতঙ্গ, বাংলার বিহঙ্গ তার মন হরণ করেছিল।
তিনি ছিলেন নির্জনতার কবি। কবিতায় এঁকেছিলেন অপরূপ প্রকৃতির ছবি। আরেকটি নামে তাকে ডাকা হয়- তিমির হননের কবি।
হ্যাঁ, জীবনানন্দ দাশের কথাই বলছি। পারিবারিক উপাধি ছিল ‘দাশগুপ্ত’। ব্রাহ্ম সমাজে দীক্ষিত হওয়ার পর ‘গুপ্ত’-কে কবি নিজেই ছেটে বাদ দিয়েছিলেন।
চরম দারিদ্র্য ও ক্লান্তি তার দেহকে গ্রাস করলেও তার মননকে স্পর্শ করতে পারেনি। বরিশাল শহরের সত্যানন্দ দাশগুপ্তের ঘর আলো করে এসেছিলেন জীবনানন্দ। সত্যানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন লোকহিতৈষী একজন মানুষ। তাকে সবাই শ্রদ্ধা করত। বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের একজন কর্ণধার ছিলেন তিনি। ছিলেন সুবক্তা ও সুলেখকও।
মা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন একজন বিদূষী, স্বভাবকবিও বটে। আদর করে ছোট্ট জীবনানন্দকে মা ডাকতেন ‘মিলু’। সেই মিলু একদিন বাংলা সাহিত্যের এত বড় নক্ষত্রে পরিণত হবে- সে লক্ষণ বাল্যজীবনেই মা বুঝতে পেরেছিলেন।
কুসুমকুমারী দাশ ছন্দে ছন্দে কথা বলতেন। রান্নাঘরে আনাজপাতি কাটতে কাটতে লিখেছিলেন ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটিঃ
‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে…’
শৈশবে প্রকৃতি তাকে যে সৌন্দর্যরূপের প্রতিবেশ দিয়েছে, সেটাই তার পরের কবিত্বের জীবনের সহায়ক ছিল- একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ছিল ‘ঝরা পালক’। এটি যখন ছাপা হয়, তখন কবির বয়স আটাশ। তিন বছর পর তিনি বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। বিয়ে করেন রোহিণী কুমার গুপ্তের মেয়ে লাবণ্য গুপ্তকে। তাদের দুটি সন্তান হয়েছিল- মেয়ে মঞ্জুশ্রী, ছেলে সমরানন্দ।
জীবনানন্দের বৈবাহিক জীবন সুখের ছিল না। বিয়ের পরও অনেকদিন তাকে বেকার বসে থাকতে হয়েছে। অনেকবার আত্মহননের কথাও ভেবেছেন। তারপর কী মনে করে যেন ফিরে এসেছেন। খুশি থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। সমরানন্দের সাথে খেতে বসলেই ছেলের পাতের ডিম নিয়ে কাড়াকাড়ি, স্ত্রী লাবণ্যের সাথে খুনসুটি- এসব তার সুখী থাকার চেষ্টাকেই নির্দেশ করে।
জীবনে সবকিছু খুব সহজভাবে নিতে পারতেন বলেই জীবনানন্দের ছিল আলাদা স্বকীয় এক জগত। শুধুই লিখেছেন। সেই লেখা ছাপাখানায় পাঠিয়ে অর্থ উপার্জনের সাবলীল পন্থাকে তিনি খুব সহজভাবে নিতে পারেননি।
কাউকে দেখানোর জন্য নয়, তিনি লিখতেন নিজের জন্য। লিখে ট্রাঙ্ক ভর্তি করে রেখে দিতেন। সারা জীবনে তার প্রকাশিত রচনার সংখ্যা বড়জোর তিনশোর মতো হবে। এখন যা পাওয়া যায়, সেগুলো তার মৃত্যুর পরে উদ্ধার করা।
জীবনানন্দের প্রিয় শহর ছিল কলকাতা। কলকাতার আবহে তিনি ছিলেন মোহাচ্ছন্ন। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের চাকরি ছাড়ার পর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। বাগেরহাটের কলেজে চাকরিরত অবস্থায়ও ছুটি পেলেই কলকাতায় চলে যেতেন। এই কলকাতাতেই কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
যেদিন ট্রামের দুর্ঘটনাটি ঘটে, তার আগের দিন রেডিও-তে আবৃত্তি করেছিলেন ‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটি। দুর্ঘটনার দিন সকালেও বন্ধুদের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
প্রতিদিনের মতো সেদিন বিকেলেও হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। দুই থোকা ডাবও কিনেছিলেন। দু’হাতে দুই থোকা ডাব নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন, এমন সময় ঘাতক ট্রামটি কবির উপর চড়ে বসে। গুরুতর আঘাত পান তিনি। কণ্ঠ, উরু ও পাঁজরের হাড় ভেঙে যায়।
তার চিৎকার শুনে পাশের চায়ের দোকানদার চুনিলাল ও অন্যরা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। ড. ভূমেন্দ্র গুহ সহ অনেক কবি-সাহিত্যিক তার প্রাণ বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেন।
সজনীকান্ত দাশ তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়কে অনুরোধ করেন কবিকে দেখার জন্য। বিধান রায় সে অনুরোধ রেখেছিলেন।
যমে-মানুষে আটদিনের লড়াই চলে। তারপর সব স্থির হয়ে যায় ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখ রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে।
জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের আজকের দিনে (১৭ ফেব্রু) বাংলাদেশের বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment