Press "Enter" to skip to content

জার্মানি, ক্যালিফোর্নিয়া, কোলকাতা ও মুম্বই চারজন চার জায়গায় বসে অনলাইনে ইন্ডোর গেম “লুডো” খেলছে চরম উত্তেজনায়।

Spread the love

#অনলাইনের লুডো।#

ভাস্কর ভট্টাচার্য : কলকাতা, ১০ জুলাই, ২০২০। রিমির পিসতুতো ভাই থাকে পশ্চিম জার্মানি। জার্মানি শুনলেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে। অনেক ইতিহাস জার্মানির। পরিশ্রমী, আধুনিক প্রযুক্তির ও উন্নয়নের দেশ। সেই সঙ্গে হিটলার। হিটলারের নিষ্ঠুরতার ইতিহাস কণ্ঠস্থ। এই হিটলারের কিছু ভালো দিক আমি অবশ্যই খুঁজে পেয়েছি। ছোটবেলায় তিনি শিল্পী হতে চেয়েছিলেন। নামকরা আঁকিয়ে হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর জীবন তাঁকে নিষ্ঠুরতার দিকে নিয়ে গেছে। তিনি ইহুদি এবং বামপন্থী নিধনের জন্য খ্যাত। মানুষ মারার জন্য গ্যাস চেম্বার বানিয়েছিলেন অনেক মানুষ ও অনেক টাকা খরচ করে। যেখানে মানুষ দম বন্ধ হয়ে মারা যেত। পৃথিবীর নৃশংস দর্শনীয় স্থানের একটি। বিশ্বের বহু উৎসাহী পর্যটক এই মৃত্যুরূপী গ্যাস চেম্বার দেখতে ভিড় করেন। খুঁজতে চেষ্টা করেন ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর নায়ককে।

এই হিটলারই শেষ জীবনে প্রেমে পড়েন। বিবাহবাসর তৈরির কিছু পরেই নিজের রিভলবারের আঙুল ছুঁয়ে নিজেকে শেষ করেছিলেন এবং সেই সঙ্গে একজন বিশুদ্ধ প্রেমিকা বা প্রেমকে। কারণ হিটলারের আত্মহননের শোকে প্রেমিকাও আত্মহত্যা করেছিলেন।

কী কথা থেকে কোন কথায় নৌকা বাইলাম।। রিমির পিসতুতো ভাই এই জার্মানিতেই চাকরি করে এখন। এই তো করোনার ছোবলের আগে ঘুরেও গেল কলকাতায়। এখন কলকাতার জল মাটি বাতাস সমস্ত কিছুর মধ্যই যেন বারুদ বা বিষ দেখতে পেয়েছে সে। যাবার সময় বলে গেছে। কলকাতার জল খারাপ ,রাস্তা খারাপ। চারিদিকে পলিউশন দেখেছে আর নাক কুঁচকেছে। রিমির আবার এ সব বিষয়ে প্রবল আপত্তি। সেও যে -কোনো সময় হয়তো কলকাতা ছেড়ে বিভুঁইয়ে চাকরি করতে চলে যেতে পারে। কারণ সেও একটা আন্তর্জাতিক তথ্য প্রযুক্তির কোম্পানির কর্মী। তবু সে কলকাতার নিন্দা সইতে পারে না।
আমি ঘরে ঢুকতেই রিমির চিৎকার, তোমার মতো অপয়া দুটো দেখিনি। ঢুকলে আর বিতান আমার পাকা ঘুঁটিটা কেটে দিল। আজ যদি হারি, তোমার সঙ্গে কথাই বলব না। পাকা ঘুঁটি, হার, বিতান এ সব শুনে আমি একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। পাশ থেকে ওর মা বলল, চারে খাওয়া, দে কেটে দে টুম্পা মাসিকে। বিস্ময়ের অন্ত নেই আমার। সব ঘোর কাটল মোবাইলে অনলাইন লুডোর ছবি, ঝিকিমিকি আলোর লুডোর ঘরগুলোকে দেখে। রিমি ,বিতান, টুম্পা মাসি এবং অমৃতাদিদির লুডোর গেম জমে উঠেছে কাটা কুটির খেলায়। জার্মানি, ক্যালিফোর্নিয়া, কোলকাতা ও মুম্বই চারজন চার জায়গায় বসে অনলাইনে ইন্ডোর গেম খেলছে চরম উত্তেজনায়। আধুনিক জীবন। প্রযুক্তির বিশ্ব। আমি বিমোহিত হয়ে গেলাম। মোবাইলে হরেক গেমের খেলার কথা জানি ইদানীং। ইন্ডোর গেমের সংজ্ঞাটা পালটে গেছে। লকডাউন মানুষকে ইন্ডোরগেমমুখি করেছে। তার একটা এই লুডো। পাড়ার দোকানেও নাকি লুডোর বিক্রি বেড়ে গেছে এই লকডাউনে। ফিরে গেলাম ছোটবেলায়। জীবনানন্দ আওড়ালাম মনে মনে একটু শব্দ পালটে। জীবন গিয়াছে চলে সংখ্যাহীন বছরের পার। তখন লুডো মানে বর্ষাভেজা দুপুর অথবা রাতের বেলা একটা পিচ বোর্ডের চৌকো খেলাঘর। চারজন ঘিরে বসে কাটাকুটি খেলা। হার এবং জিত। খুশি অথবা হার। কখনও আবার পাতা উলটে সাপ লুডো। ছোট সাপ বড় সাপ মই বেয়ে উঠে যাওয়া। ভাগ্যের ওঠাপড়ার কাহিনি যেন ওখান থেকেই শেখা। ৯৯ এর ঘরে এক লম্বা সাপ, যার লেজ পাঁচে গিয়ে শেষ। একবার তার মুখে পড়লে যেন একালের শেয়ার বাজারের পতন। বা আচমকা উঁচু থেকে পড়ে যাওয়া। চরম হতাশা। এই আশা আর হতাশা নিয়েই চলত আমাদের ঘরবন্দি লুডোর ছক্কা দান। শেষ কবে লুডো খেলেছি ভাবছিলাম। এখন রিমি এবং তার বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে থাকা পিসতুতো দাদা দিদি মাসিদের অনলাইন লুডোর দিকে তাকিয়ে আমার ফেলে আসা সেই ছোট্ট পৃথিবীর ছবি ভেসে উঠছে বার বার। রুমাল চোর, এক্কাদোক্কা, কানামাছি, চোরপুলিশ,কুমিরডাঙার শিশুকাল। ফেলে আসা সেই ছাদের বিকেল। এই প্রজন্মের দুপুর বিকেলের কোনো ভেদ নেই। রাতে শুয়ে পড়ার কোনো তাড়া নেই। লকডাউনে তো নেইই। রাত দেড়টা দুটোতেও চোখ আটকে মোবাইলে। তা সিনেমা, খেলা গান যাই হোক। এখন ওরা লুডোয় মগ্ন। জার্মানি, মুম্বই, কলকাতা, এবং আমেরিকা এখন এই গভীর রাতে লুডো খেলছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল মুঘল রাজা আকবরের লুডোপ্রিয়তার বর্ণনা কোথায় যেন পড়েছিলাম। মুঘল রাজাদের দরবারে এই খেলাকে বলা হত ‘চাপড়’ ( chapad) . অজন্তা ইলোরা গুহায় ষষ্ঠ শতাব্দীতে এই ধরনের খেলার ছবি মিলেছে। চিনের সিচুয়ান পূর্ব অঞ্চলে হান এর ক্লিভ গুহাতেও নাকি লুডো খেলার নমুনা মিলেছে।
বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে লুডোর ইতিহাস। জার্মানে লুডো শান্ত বুদ্ধির খেলা। খেলার নামের মধ্যেই শান্ত থাকার পরামর্শ। এই লুডো সেখানে ‘ম্যান ডোন্ট গেট অ্যাংরি’ হিসেবে বিবেচিত। হাঙ্গেরিতে আবার ‘ হু লাগস ( laughs) অ্যাট দ্য এন্ড’। রোমানিয়ায় আবার ‘ডোন্ট বি আপসেট ব্রাদার’। এই লুডো শব্দটা এসেছে লাতিন শব্দ থেকে। এ সবের ইতিহাস পাওয়া যাবে R.C Bell নামক এক সাহেবের বই থেকে।এমনই এক লেখক প্যাডিফিল্ড পিটার। তিনি লিখেছেন রোমাঞ্চকর লুডোর ইতিহাস ,’ওয়্যার বিনীদ দ্য সি’। লুডো খেলা এবং তার বিবর্তন ঘটনাবলি নিয়ে। এই খেলা নিয়ে লেখার অন্ত নেই। এক সময়ে পৃথিবী বিখ্যাত লুডো নির্মাতার খ্যাতি কুড়িয়েছিল ”সরি’ব্র্যান্ড নামে খ্যাত এক সংস্থা। লুডো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত। স্পেনে পারচিস, কলম্বিয়ায় ‘পারকুইস’, লাটাভিয়ায় ‘রিকু রাকু’। চায়না, মালয়েশিয়ায় ‘এরোপ্লেন চেজ’। ইংলন্ডে ১৮৯৬ সালে লুডো প্রথম খেলতেন রয়াল নেভির লোকজন অবসর কাটাতে। বলা হত ‘উকার্স’। ভারতীয়দের কাছে পরিচিত ছিল ‘পাচিসি’ ( Pachisi). কোথাও কোথাও আবার ‘রেস গেম’, বোর্ড গেম’, ‘ডাইস গেম’ নামেও এর পরিচয়। অতএব, লুডো আজ রাত জেগে অনলাইনে খেলা হলেও, এর যাত্রা শুরু হয়েছিল গুহার যুগের সময় থেকে। তবে এর যাত্রাপথে যেমন নানান মজার ঘটনা ঘটেছে, তেমন সামান্য বিরোধে প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটেছে। এই তো কিছুদিন আগেই গ্রেটার নয়ডায় দয়ানগর গ্রামে চারজন লুডো খেলছিলেন, হঠাৎ বিরোধ এবং এক বন্ধুর হাতে গুলিতে প্রাণ গেল আরেক বন্ধুর। কারণ নাকি বন্ধুটি কেশে ছিল। করোনা বিতর্কে প্রাণ গেল বন্ধুটির। আমার জীবনে এক বড় ধরনের অভিমান এঁকে দিয়েছিল এই লুডো। সেই যেদিন লুডো খেলতে খেলতে মৌরীর কাছে হেরে গিয়েছিলাম। মৌরী আমার ছোটবেলায় দেখা বিশেষ মেয়ে। আমার দূর সম্পর্কের বোন। হেরে লুডো উলটে দিয়ে চলে এসে ছিলাম। তিনদিন কথা বলিনি। মৌরী হেসে বলেছিল, এই হারাতেই তোর এত অভিমান?
মনটা ভারী হয়ে উঠল, মনে মনেই বললাম, মৌরী আমি যে গোটা জীবনেই হেরে গেলাম! হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বেলা দশটা বাজে রিমি বলল, লুডো খেলবে? সব তো লকডাউন। আমি বললাম, দূর হেরে গিয়ে বোর্ড উলটে দিতে না পারলে সেই খেলায় মজা নেই। নেই ইচ্ছেমতো চাল ফেরত নেবার সুযোগ।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.