শম্পা দেবনাথ : ভাগলপুর, ১২ জুন, ২০২৪। সারা বছর ধরে জামাই বাবাজীরা অপেক্ষা করেন একটি বিশেষ দিনের জন্য তা হলো জামাই ষষ্ঠী। যদিও আজকের দিনে অনেক জামাই রাজারা জামাই ষষ্ঠীর দিনে শ্বশুর বাড়িতে হাজির হতে পারেন না সেই ক্ষেত্রে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী কব্জি ডুবিয়ে ভুরিভোজের জন্য একটি বিশেষ দিন বেছে নেন। ইদানিং কালে জামাই ষষ্ঠীর আয়োজন হোটেল রেস্টুরেন্টে মহা ধুমধামের সাথে আয়োজন করা হচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে আধুনিক সমাজে বৌমা ষষ্ঠী পালন করা হচ্ছে। এই সব কিছুর দায়িত্ব ও হোটেল কতৃপক্ষ নিয়ে নিচ্ছেন। এত কিছু পরিষেবা নেওয়ার জন্য কিছু মূল্য অবশ্যই দিতে হবে। জামাই ষষ্ঠীর দিনে সকাল থেকেই জামাই বাবাজীদের খুশি করার জন্য শাশুড়ি মায়েরা পরম যত্নে নানান ধরণের খাবারের আয়োজন করেন। সেই মেনুতে যেমন ডাল, ভাত, পোলাও, ভাজা, মাছ , মাংস, সব্জি থাকে তার সাথে থাকে নানান পদের মিষ্টি। জামাইদের জন্য শাশুড়ি মায়েরা নানাবিধ ফলের ও আয়োজন করেন। বাঙালি পরিবারে এই প্রথাটি বহু প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। কিন্তু কখনো আমরা ভেবে দেখিনি …এই প্রথাটির পেছনে কোন মনস্তত্ত্ব কাজ করে? তৎকালীন সময় শাশুড়ি মায়েরা নিজেদের পরমায়ু ও যাতে জামাই পায় সেই প্রার্থনা ঈশ্বরের কাছে করতেন। কারণটা কি? একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে …আসলে তারা চাইতেন তাদের জামাই সুস্থ -সবল -দীর্ঘায়ু থাকলেই শাশুড়ি মায়ের মেয়েও সারাজীবন ধরে শাক -ভাতে আর শাঁখা – পলায় স্বস্তিতে থাকবে। কিন্তু সেই সময় বাস্তব চিত্রটি কি ছিল? শাঁখা – পলায় থাকলেও স্বস্তিতে একেবারেই তারা থাকতেন না। চূড়ান্ত অসম্মানিত – অপমানিত এবং অত্যাচারিত হতে হতে তাদের জীবনকাল শেষ হতো। বরং উল্টো চিত্রে তাদের স্বামী মহাশয় পরলোক গমন করলে বরং তারা স্বস্তি পেতেন!
দিন বদলের সাথে সাথে মেয়েরা এখন অনেকাংশেই স্বাবলম্বী হয়েছে। তবুও প্রথাটি আজও একই ভাবেই রয়ে গেছে। এবার বলছি বৌমাদের কথা। যে সকল নারীরা সারা বছর ধরে সংসার সামলান তারা তো এক কথায় দশভূজা। বছরের ৩৬৫ দিন ২৪ ঘন্টা তারা মাল্টিটাস্কিং কে গুলে খাচ্ছেন। সংসারের প্রতিটি সদস্যের ভালো-মন্দ, আবদার- দরকার, অভ্যেস – আতিশয্য, মুড- ডায়েট সবকিছুকে অতি স্বাচ্ছন্দে জাগলিং করে চলেছেন। যারা কর্মরতা তারাও কোন অংশে কম যান না। অফিস কাছারি সামলে কতোটা যেন অপরাধবোধ নিয়েই তারা বাড়িতে এসে প্রবল বিক্রমে নিজেদের লেভেলের ওপরে উঠে কাজগুলো ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন।
৩৬৫ দিনের মধ্যে একটি দিন যদি বৌমাদের জন্য ধার্য হয় তবে মনে হয় না তাতে কোনো আকাশ ভেঙে পড়বে। ধরুন যদি এমন হয় …. তারা জানে সেই বিশেষ দিনটা তাদের জন্য ধার্য করা হয়েছে । শাশুড়িমা শ্বশুরমশাইকে বলে দিয়েছেন…”তুমি বাপু আগের দিনই বাজারটা করে রেখ। একে তো উপোস আছে তার উপর একার হাতে কেটে -বেটে- রান্না করে মেয়েটাকে খাওয়াবো।” তার পছন্দের কথা ভেবে শ্বশুর মশাই থলে ভরে শাক -সবজি, মাছ -মাংস ,ফলমূল এনে হাজির। ননদটি শাশুড়ি মাকে রান্না ঘরের কাজে হেল্প করছে, আর দেওর বসার ঘরটিকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিচ্ছে। ফুলদানিতে কিছুটা রজনীগন্ধার ফুল রাখা হয়েছে। সোফাতে নতুন কভার, বিছানাতে আসমানী রং নরম একটি চাদর। এক সপ্তাহ আগেই শাশুড়ি মা এবং শ্বশুরমশাই মিলে উপহার হিসেবে নামকরা একটি দোকান থেকে লাল রং জরিপাড় পিওর সিল্ক কিনে এনে রেখেছেন । সেই বিশেষ দিনটিতে দেওর আর ননদ মিলে তাদের হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে বৌদির জন্য উপহার প্রসাধনী, চকলেট আর বেল কুঁড়ির মালা এনে হাজির। তার সেদিন রান্নাঘরে নো এন্ট্রি। সেই দিনটিতে শাশুড়ি মায়ের ছেলেটিও অফিসে ছুটি করেছে। বাড়িতে কোনো কাজে যদি তার দরকার হয় মা সেদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রান্না করেছে দেখে ছেলে খাবার পরিবেশনের দায়িত্বটি নিয়ে নিয়েছে। সুন্দর করে পাঁচ পদে থালা সাজিয়ে, জল পিঁড়ি করে সে তার অর্ধাঙ্গিনী জন্য ভালোবেসে – যত্নে থালাটি অতি সাবধানে রাখে যেখানে আসনে তার অর্ধাঙ্গিনী নতুন পিওর সিল্ক শাড়িতে, বেল কুঁড়ির মালায় লজ্জা – লজ্জা মুখে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে আছে! শাশুড়ি মা পাশে বসে তালপাতার পাখায় বৌমাকে হাওয়া করছেন।শ্বশুর মশাই সামনে একটি চেয়ারে বসে বউমার আর কি লাগবে না লাগবে সে ব্যাপারে তদারকি করছেন। সেই সময় শাশুড়ি মা শ্বশুরমশাই এর ওপরে কপট রাগ দেখান…”কতো করে তোমাকে বললাম জলভরাটা আনতে, জানো না নাকি মেয়ের আমার জলভরাটা পছন্দ … না উনি কাঁচাগোল্লা এনে হাজির!”শশুর মশাই আমতা আমতা করেন “কি করবো গিন্নি! আমি যেতে যেতে জলভরা শেষ হয়ে গেছিল যে… আচ্ছা কাল এনে দেবো!” দেওর এবং ননদটি সোফায় বসে সম্পূর্ণ মুহূর্তটি ক্যামেরায় -মোবাইলে ক্যাপচার করছে, সাথে চলছে বৌদির সাথে ঠাট্টা- তামাশা।
পাঠকরা আপনারাই বলুন এমন একটি চিত্রকল্প আশা করা কি খুব অন্যায়? যারা পরিবারের জন্য দিনরাত এক করছে… বছরে একটি মাত্র দিন শুধুমাত্র তাদের কথা ভেবে পরিবারের বাকি সদস্যরা যদি একটু উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসে, তবে সেই মেয়েটি ওই একটি দিনের ভালবাসার প্রতিদানে সারা জীবন তাদের হয়ে রয়ে যাবে। শাশুড়ি মায়ের তালপাতার বাতাসে উড়ে যাবে সারা বছরের ক্ষত, জ্বালা, বিদ্বেষ, অভিমান, অনুযোগ।
এটি শাশুড়ি মায়ের হাতে বেড়ে দেওয়া জামাইষষ্ঠীর কোনো থালা নয়। আমাদের সংযুক্ত পরিবারের দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের এই থালাটি আমার নিজের হাতে সাজানো।
থালাটিতে রয়েছে ভাত, কাঁচালঙ্কা ,আম দিয়ে টক ডাল, ঢেঁড়স ভাজা, পেঁপে ঘষে বাদাম দিয়ে তরকারি, চিতল মাছের পেটি, স্যালাড, আমের চাটনি ,পাঁপড় এবং টক দই।
Be First to Comment