জন্মদিনে স্মরণঃ পল্লীকবি জসীম উদ্দীন
বাবলু ভট্টাচার্য : ‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে/ আমাদের ছোট গাঁয়/ গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়/মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি/ মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি/ মায়ের বুকেতে/ বোনের আদরে/ ভাইয়ের স্নেহের ছায়।’
পল্লী জসীম উদ্দীনের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতা আওড়ে হারিয়ে যেতে পারেন সুদূর গহীন গাঁয়ে। মনে হতে পারে, পল্লীকবির হাত ধরেই হেঁটে চলেছেন গ্রামের মেঠো পথ ধরে। শুধু নিমন্ত্রণ কেন, জসীম উদ্দীনের কবিতায় বারংবারই ফুটে উঠেছে বাংলার গ্রাম আর গ্রামীণ ঐতিহ্য। আর তাই তো তিনি পেয়েছিলেন ‘পল্লীকবি’ উপাধি।

পল্লীকবি ছেলেবেলা থেকেই লেখালেখি করতেন। ১৪ বছর বয়সে কল্লোল পত্রিকায় তার কবিতা প্রকাশ হয়। তখন তিনি নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। জসীম উদ্দীনের প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘রাখালী’ (১৯২৭)।
১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে যোগদানের মাধ্যমে তিনি কর্মজীবনে পা রাখেন। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত এ পদেই বহাল ছিলেন তিনি।
১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
বাংলার আবহমান জীবনধারাকে তিনি ব্যক্ত করতেন কবিতার মাঝে। গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি, নদ-নদী, সমাজ, ঐতিহ্য মিশে গেছে তাঁর কবিতায়। বাংলার কৃষ্টিকে অতীব যত্ন সহকারে লেখার মধ্যে তিনি বারবার ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর কবিতা পড়লে কেমন যেন একটা মায়া পড়ে যায় বাংলা মায়ের প্রতি। তাঁর কবিতা পাঠককে অনেক বেশি ভাবায়। অদ্ভুত মুগ্ধতা রয়েছে তাঁর লেখা কবিতার ভাবরসে। তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যে সৃষ্টি করেন এক নতুন আবহ।

শহরকেন্দ্রিক সভ্যতা থেকে নিজেকে সরিয়ে গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাবনায় তিনি কবিতার চিত্রপটে পল্লীসমাজকে তুলে ধরতেন। কেবল পল্লীসমাজই নয় মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ নিয়েও তিনি কবিতা লিখেছেন। উদাহরণস্বরূপ কবর কবিতার কথাই যদি বলা হয়। তাঁর কবিতার শুরু থেকে শেষে প্রতিটি উদ্ধৃতিতেই রয়েছে কাব্যিক ছন্দের সমাহার।
পল্লীকবি জসীমউদ্দিন লিখে গেছেন অসংখ্য কাব্য, বেশ কিছু নাটক ও আত্মকথা। কাব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য– ‘রাখালী’, ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, ‘বালুচর’, ‘ধানখেত’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’, ‘হাসু’, ‘রূপবতি’, ‘মাটির কান্না’, ‘এক পয়সার বাঁশী’, ‘সকিনা’, ‘সুচয়নী’, ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’, ‘মা যে জননী কান্দে’, ‘হলুদ বরণী’, ‘জলে লেখন’ প্রভৃতি।
নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য– ‘পদ্মাপার’, ‘বেদের মেয়ে’, ‘মধুমালা’, ‘পল্লীবধূ’, ‘গ্রামের মেয়ে’, ‘ওগো পুষ্পধনু’, ‘আসমান সিংহ’ প্রভৃতি।
আত্মকথার মধ্যে উল্লেখযোগ্য– ‘যাদের দেখেছি’, ‘ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায়’, ‘জীবন কথা’, ‘স্মৃতিপট’, ‘স্মরণের সরণী বাহি’ প্রভৃতি। তিনি কবিতা, নাটক, আত্মকথা ছাড়াও ‘বোবা কাহিনী’ নামের একটি উপন্যাস ও কিছু সংখ্যক গান এবং ভ্রমণকাহিনী লিখেন৷

জসীম উদ্দীনের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে :১৯৫৮ সালের প্রেসিডেন্টস এওয়ার্ড ফর প্রাইড অফ পারফরমেন্স, ১৯৭৬ সালের ইউনেস্কো পুরস্কার, ১৯৭৬ সালের একুশে পদক, ১৯৭৮ সালের স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর)। ১৯৬৮ সালের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডি. লিট উপাধি দেয়।
কবি জসীম উদ্দীন ১৯০৩ সালের আজকের দিনে (১ জানু) ফরিদপুর শহরতলির তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।


Be First to Comment