মধুমিতা শাস্ত্রী, ১ সেপ্টেম্বর ২০২০ঃ বর্ষার মেঘলা আকাশ, হালকা হাওয়া আর তার সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। এ হলো ইলিশ জালে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ। সেই উপযুক্ত পরিবেশ থাকলেও এখন আর আগের মতো ইলিশ ধরা পড়ছে না মাঝিদের জালে। সরকারি নির্দেশিকা অমান্য করে প্রায় সারাবছর যেভাবে খোকা ইলিশ ধরা হয় তাতে সঠিক সময়ে বড় ইলিশ ও বেশি পরিমাণে ইলিশ পাওয়া যায় না। আগে বর্ষাকালে প্রতিটি বাড়িতে হেঁশেল থেকে ইলিশের গন্ধ পাওয়া যেতো। একটা বাড়িতে ইলিশ রান্না হলে আশপাশের লোক ঠিক গন্ধ পেয়ে যেতো। এখন ইলিশের এতো আকাশচুম্বি দাম যে সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্তের রান্নাঘর থেকে গন্ধ পাওয়া দুষ্কর।
আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র এই তিন মাস ইলিশের মরশুম। যদিও এখন সারাবছর সংরক্ষণ করে রাখা ইলিশ পাওয়া যায় বাজারে। তবে সে ইলিশে স্বাদ পাবেন না। তাই মরসুমি ইলিশ স্বাদে গুণে অতুলনীয়।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ইলিশ প্রীতি থেকে কবিতা লিখে ফেললেন। ইলিশ আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এ যেন একে অপরের জন্য সৃষ্টি। তাই কবি লিখেছেন –
“ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি!
পরীর কানের দুল,
ইলশে গুঁড়ি! ইলশে গুঁড়ি!
ঝারো কদম ফুল।”
শুধু একালে নয় সেকালেও ইলিশ মাছের সমাদর ছিল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র একবার কথা প্রসঙ্গে গোপাল ভাঁড়কে জিজ্ঞেস করলেন, বাঙালিদের মধ্যে দেখা হলেই ইলিশ মাছের দাম জিজ্ঞাসা করে, এর কারণ কী? গোপাল ভাঁড় উত্তরে বলেছিলেন -‘এটা বাঙালির স্বভাব।’ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়ের মধ্যে এই নিয়ে তর্কবাধে। শর্ত ছিল, গোপাল ভাঁড় নদীর ধার থেকে ইলিশ হাতে ঝুলিয়ে বাড়িতে ফিরবে আর সেই সময় যদি কেউ দাম জিজ্ঞাসা না করে তবে সে একশো টাকা পুরস্কার পাবে। আর যদি একজনও জিজ্ঞেস করে তবে পুরস্কার তো পাবেই না উল্টে পঁচিশ ঘা চাবুক খেতে হবে। এই শর্তে গোপাল ভাঁড়কে মহারাজ জেলে- ডিঙির থেকে একটা বড় সাইজের ইলিশ মাছ কিনে দিলেন আর সঙ্গে দুজন বিশ্বস্ত প্রহরী পাঠালেন সত্যাসত্য জানার জন্য। গোপাল ভাঁড় মাছ হাতে নিয়ে একটা বটগাছের নীচে গিয়ে পরনের ধুতিটা খুলে মাথায় পাগড়ি করে নিলেন। গোপাল ভাঁড় যখন এই অবস্থায় লোকালয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন সবাই ভাবল গোপাল পাগল হয়ে গিয়েছে। অনেকে হাসাহাসি করল, বাচ্চারা ঢিল ছুঁড়ল তবে কেউ দাম জিজ্ঞেস করল না। ফলে গোপাল ভাঁড় জিতে গেলেন।
আস্ত ইলিশ মাছ ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া একসময় রেওয়াজ ছিল। মা-ঠাকুমাদের মুখে শুনেছি, ইলিশ ‘আবার ছোটো কী?’ বড় ছাড়া ছোটো ইলিশ তখন দেখা যেতো না। আসলে তখন চাহিদা কমছিল। তাই ছোটো ইলিশ ধরা হতো না। এখন সারা বিশ্বব্যাপী ইলিশের প্রচুর চাহিদা থাকায় অর্থের লোভে ছোটো ইলিশ ধরে নেওয়া হয়। তাই বাজারে ছোটো ইলিশই বেশি দেখা যায় তুলনামুলক ভাবে।
এবছর বড় ইলিশ অর্থাৎ এককেজি ওজনের মাছের দাম পড়ছে ১২০০/- টাকা। মাঝারি ইলিশের দাম পড়ছে ৮০০/- টাকা। আর ছোটো ইলিশের দাম পড়ছে ৬০০/- টাকা। যদিও এই দাম ওঠানামা করে বাজারের জোগান ও চাহিদার উপর।
স্বামী বিবেকানন্দের ইলিশপ্রেম মনে রাখর মতো। তিনি জীবনের শেষ সময়ে আত্মতুষ্টি করে ইলিশ মাছ ভাজা, মাছের তেল, মাছের ঝোল ও মাছের টক খেয়েছিলেন। জানা যায় এইসব খেয়ে তাঁর শরীরে এতই শক্তি হলো যে, লাইব্রেরিতে বসে কয়েকটি ছাত্রকে পড়াতে লাগলেন পানিনির ব্যাকরণ ঘন্টার পর ঘন্টা। তারপর হাঁটতেও বেরলেন। অনেক গল্প করলেন অন্যদের সাথে।
পৃথিবীর মোট বারোটি দেশে ইলিশ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৭৫% ইলিশ বাংলাদেশে ধরা হয়। এর পরের স্থানে আছে মায়ানমার এবং ভারত। এছাড়াও অন্যান্য যেসব দেশে ইলিশ পাওয়া যায় সেগুলি হল- পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া, থাইল্যান্ড, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ভিয়েতনাম।
আসল স্বাদ ও গন্ধে ভরপুর প্রকৃত রুপালি ইলিশ বিশ্বের মাত্র দুটি দেশে পাওয়া যায় বাংলাদেশ ও ভারত। ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। পদ্মার ইলিশ পৃথিবী বিখ্যাত। ইলিশের প্রধান বাসস্হান বঙ্গপোসাগর। ডিম পাড়ার সময় এরা মোহনা ও নদীর স্রোতে ছুটতে থাকে। ডিম পাড়া হয়েগেলে আবার সাগরে ফিরে যায়। এই আাসা যাওয়ার পথে মাঝিদের জালে ধরা পড়ে। আর বিভিন্ন হাত ঘুরে বাঙালির পাতে এসে পড়ে। তাই একমাত্র বাঙালি জাতি গর্বকরে বলতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু মাছ আমাদের এখানে পাওয়া যায়।
Be First to Comment