জন্মদিনে স্মরণঃ ছবি বিশ্বাস
বাবলু ভট্টাচার্য : ‘জলসাঘর’ চলচ্চিত্রের দাপুটে কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বিশ্বম্ভর রায় যখন ছড়ি হাতে দেখিয়ে চলেন তার পূর্ব-পুরুষদের ছবি কিংবা ১৯৬২ সালে নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় উঁচুতলার রাশভারী মানুষ তখন সেই অভিনয় সবাইকে শিহরিত করে।
১৯৫৬ সালে তপন সিংহ পরিচালিত ‘কাবুলিওয়ালা’ চলচ্চিত্রে তিনি যখন পাগড়ি এবং জোব্বা পরে ‘হিং চাই হিং’ বলে পর্দায় আসেন কাবুলিওয়ালার বেশে এবং একরত্তি মেয়ে মিনির সঙ্গে গড়ে ওঠে তার অসমবয়সী সখ্য, আর ছবির শেষে যখন রবি ঠাকুরের গল্পটিতে দেখা যায়, পিতৃহৃদয়ে কোথাও দেশভাগের কাঁটাতার নেই, তখন সেই বোধ একেবারে স্ব-শরীরে জেগে ওঠে আমাদের সামনে।
প্রায় প্রতিটি ছবিতে তার অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ১৯৫৯ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমি তাকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান জানান।
ছবি বিশ্বাসের আরও একটি বৈশিষ্ট্য যে তিনি আদ্যপান্ত নাগরিক, অর্থাৎ আরবান পিপল। পঞ্চাশের দশকে শহর কলকাতায় বিলিতি কেতাদুরস্ত বঙ্গীয় অভিজাতকুল কেমন ছিলেন, তার একটি নিখুঁত প্রতিচ্ছবি ছবি বিশ্বাস অভিনীত বিভিন্ন চরিত্র। স্যুট-টাই এবং ধুতি-পাঞ্জাবি– দু’টি বেশেই তিনি ঔপনিবেশিক বাংলার একটি চেহারাকে ধরে রেখেছেন।
ছবি বিশ্বাস। প্রকৃত নাম শচীন্দ্রনাথ। বাংলা চলচ্চিত্রের একজন বিখ্যাত বাঙালি অভিনেতা। তার অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ এবং তপন সিংহের পরিচালনায় ‘কাবুলিওয়ালা’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি বহু বাণিজ্য সফল চলচ্চিত্রে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন।
তিনি মঞ্চাভিনয়েও বিখ্যাত ছিলেন। সমাজ, ধাত্রীপান্না, মীরকাশিম, দুইপুরুষ, বিজয়া প্রভৃতি নাটকে ছিল তার উল্লেখযোগ্য অভিনয়।
অভিনয় ছাড়াও তিনি ‘প্রতিকার’ (১৯৪৪) এবং ‘যার যেথা ঘর’ (১৯৪৯) নামক ছবি দুটির পরিচালকও বটে। তবে পরিচালক হিসেবে তিনি বিশেষ সাফল্য লাভ করতে পারেননি।
তার পিতার নাম ভূপতিনাথ। ছবি বিশ্বাসের পরিবার ছিল কলকাতার নিবাসী। যাত্রা ও থিয়েটারে বরাবরই উৎসাহ ছিল ছবি বিশ্বাসের। প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়ার সময় এমেচার থিয়েটার করেছেন শিশির ভাদুড়ী, নরেশ মিত্রের মতো বড় বড় অভিনেতাদের সঙ্গে।
১৯৩৬ সালে ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ। এর পর অজস্র ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। প্রথম দিকের কয়েকটিতে নায়কের চরিত্রে এবং পরে পার্শ্বচরিত্রে।
অসামান্য দক্ষ অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের অভিনীত কয়েকটি স্মরণীয় চলচ্চিত্রের মধ্যে অন্যতমঃ ‘চোখের বালি’, ‘শুভদা’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘প্রতিশ্রুতি’, ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’, ‘সবার উপরে’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘হেডমাস্টার’ ইত্যাদি।
ছবি বিশ্বাস বললেই একটি বিশেষ উচ্চতা, জলদগম্ভীর স্বর, একটি চাহনি, পদক্ষেপের বিশিষ্ট ধরণ দর্শকের মানসপটে ভেসে ওঠে। সব মিলিয়ে, বাঙালির কল্পনায় তিনি স্বয়ং একটি ‘টাইপ’!
মোটরগাড়ি দুর্ঘটনায়, ১১ জুন ১৯৬২ সালে মারা যান তিনি।
ছবি বিশ্বাস ১৯০০ সালের আজকের দিনে (১৩ জুলাই) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment