স্মরণ : চারু মজুমদার
“কোনো কথার মৃত্যু হয় না। আজ আমরা যা বলছি হয়তো মানুষ আজই তা গ্রহণ করছে না; তাই বলে আমাদের সে প্রচার ব্যর্থ হচ্ছে না, কথাগুলো মানুষের মধ্যে থেকে যাচ্ছে।”
——– কমরেড চারু মজুমদার
গোপাল দেবনাথ : চারু মজুমদার মধ্যবিত্তের নায়ক হতে চাননি, তিনি চেয়েছিলেন নিপীড়িত মানুষকে নায়কের আসনে বসাতে। আর তাই ভারতবর্ষের বুকে তিনি তৈরি করেছিলেন ভূমিকম্প। সেই ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়া দার্জিলিং জেলার পাহাড় থেকে নেমে এসে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো ভারতের রাজনীতি আর প্রশাসনের ঘুণে ধরা কাঠামোটাকে।
১৯১৯ সালের ১৫ মে রাজশাহী জেলার মাতুলালয়ে জন্ম গ্রহণ করেন চারু মজুমদার। বাবা বীরেশ্বর মজুমদার ছিলেন ধনী মধ্যস্বত্ত্বভোগী। অথচ সেই পরিবারেই চারু মজুমদারের জন্মটা যেন খানিকটা দৈত্যকূলে প্রহ্লাদের মতো।
১৯৩৩ সালে শিলিগুড়ি বয়েজ স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে ভর্তি হন পাবনা এডোয়ার্ড কলেজে। আর এমন সময়েই এল তেভাগা আন্দোলনের ঝড়। সেটা ১৯৩৬ সাল। মজার ব্যাপার তেভাগা আন্দোলন শুধু হাড়-হাভাতে চাষাদের আন্দোলন হয়ে থাকল না। তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন চারু মজুমদার নিজেও। আর কর্মস্থল হলো জলপাইগুড়ি জেলা।
ভারতের মার্কসবাদী রাজনীতির এই প্রবাদ পুরুষ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ১৬ জুলাই। প্রায় ১২ দিন ধরে লকআপে অত্যাচার সহ্য করেছিলেন। তারপর ২৮ জুলাই ভোর ৪টায় কেবলমাত্র পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে পুলিশের প্রহরায় পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তাঁর নশ্বর দেহ।
মাত্র ৯৬ পাউন্ড ওজনের, অত্যন্ত দুর্বল শারীরিক কাঠামোর অধিকারী এই হাঁপানি আক্রান্ত মানুষটি স্বাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাস পাল্টে দেয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
কলকাতা শহরের এন্টিলি নামে একটি এলাকা। ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই ভোরবেলা কলকাতার গোয়েন্দা পুলিশের দল ওই এলাকার একটি দোতলা বাড়ি ঘিরে ফেলে। ওই বাড়িতেই আত্মগোপন করেছিলেন এক সময়ে ভারতের রাজনীতির অগ্নিপুরুষ চারু মজুমদার।
কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে চারু মজুমদারের গোপন আস্তানার কথা ফাঁস করে দিয়েছিল তাঁরই ঘনিষ্ঠ সহযোগী দীপক বিশ্বাস।
দীপক বিশ্বাস নকশাল আন্দোলনের অন্তিম সময়ে হয়ে উঠেছিলেন চারু মজুমদারের সবচাইতে কাছের মানুষ। চারুবাবু তাকে বিশ্বাস করতেন। ১৯৬৭ সালে, মাও জে দং-এর সঙ্গে দেখা করতে এই দীপক বিশ্বাসকেই চীনে পাঠানো হয়েছিল।
আজও চারু মজুমদারের বেঁচে থাকা অনুসারীদের কাছ থেকে জানা যায়, দীপক বিশ্বাস পুলিশের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মুখ খোলে। আর তাতেই ১৬ জুলাই ভোরে ধরা পড়েন চারু মজুমদার।
চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর দীপক শিলিগুড়িতে ফিরে আসে। কিন্তু নকশালবাদীরা বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নেয়। শিলিগুড়িতে চারুবাবুর বাড়ি থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে হিল কার্ট রোডে তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়।
চারু মজুমদার তাঁর হাজির করা দলিলে বলেছিলেন, একমাত্র সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের পথ ধরেই ভারতের কৃষক ও জনসাধারণ মুক্তি লাভ করবে সমস্ত শোষণ আর অত্যাচার কবল থেকে এবং ভারতবর্ষকে প্রকৃত ভাবে স্বাধীন করা সম্ভব শুধুমাত্র গণ বিপ্লবের মাধ্যমে।
তিনি বলেছিলেন, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে এক নয়া গণতান্ত্রিক সমাজ গড়া।
তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে লক্ষ লক্ষ তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিপ্লবের আগুনে। তারা হাসি মুখে দেশের মুক্তির স্বার্থে প্রাণ বিসর্জনও দিয়েছিল। নতুন ভাষায় তারা লিখতে চেয়েছিল ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাস।
গ্রেফতারের পর চারুকে কলকাতার লালবাজারে পুলিশ লকআপে রাখা হয়েছিল।
পুলিশ স্টেশনে আটক অবস্থায় চারু মজুমদারের কাছে তাঁর অবস্থার কথা জানতে চেয়েছিলেন ডাক্তার কন্যা অনীতা।
“এই পুলিশগুলোর সঙ্গে আছি, যা হওয়ার তাই হবে”– পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে এটাই ছিল তাঁর শেষ কথা।
২৮ জুলাই, ১৯৭২ গ্রেফতারের মাত্র ১২ দিন পর পরিবারকে জানানো হয় যে, চারু মজুমদার আর নেই।
মেডিকেল কলেজ মর্গে চারু মজুমদারের মৃতদেহ দেখানোর জন্য একের পর এক লাশবাহী ট্রে খোলা হয়েছে। শেষ ট্রেতে রাখা ছিলো তাঁর প্রাণহীন দেহ। চারু মজুমদারের ছেলে অভিজিৎ সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, তার বাবার পায়ের আঙুলগুলো অস্বাভাবিক কালো ছিল, যেন পোড়ানো হয়েছে।
এর পর একটা গাড়িতে করে পরিবারকে ক্রিমেটোরিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়, যদিও কমিউনিস্ট হওয়ায় চারু মজুমদার কখনই চাননি তাঁর দেহ দাহ করা হোক। ক্রিমেটোরিয়ামের চারপাশ সেনাবাহিনীর লোকজন ঘেরাও করে রেখেছিল।
শেষকৃত্য সম্পাদন করতে চেয়েছিলেন স্ত্রী লীলা, কিন্তু তাঁকে অনুমতি দেয়া হয়নি। ছোট অভিজিৎকেই চিতায় আগুন ধরাতে বলা হয়েছিল। সব মিটে যাবার পর চারু মজুমদারের পরিবারকে অবিলম্বে কলকাতা ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
অবশ্য সেই রাতটা তারা একটা হোটেলে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাদের এক রাতের জন্য রুম ভাড়া দেয়ায় ওই হোটেলের ম্যানেজারকে গ্রেফতার করা হয়।
Be First to Comment