ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫। জগতবাসীকে শ্রীকৃষ্ণ নাম দিতে কলি যুগে স্বয়ং
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অবতীর্ণ হয়েছিলেন নদীয়া নগরে
“শ্রীচৈতন্যদেব ” নামে ৷ তা আমরা যারা গৌর ভক্ত সবাই বিশ্বাস করি ৷ যাঁরা তাঁর জীবনী পড়েছেন তাঁরা জানেন তাঁর দুজন স্ত্রী ছিলেন ৷ প্রথম জন লক্ষ্মীপ্রিয়া সর্পাঘাতে মারা গেলে নবদ্বীপের সবচেয়ে ধনী সনাতন মিশ্রের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় ৷ যুবতী স্ত্রীকে রেখে শচীমাতার অনুমতি নিয়ে গৌরাঙ্গ সন্ন্যাসী হন ৷ এই বিষ্ণুপ্রিয়া নিমাই পত্নী হিসাবে বিশেষ পরিচিত ৷ তাঁর নামে এখন নবদ্বীপে একটি রেল স্টেশনও আছে ৷ প্রথমাপত্নী লক্ষ্মীপ্রিয়া অনেকটা অন্তরালে রয়ে গেছেন ৷ছেলেবেলা থেকে গৌর ছিলেন মেধাবী ছাত্র ৷ তিনি আমাদের পূর্বস্থলীর বিদ্যানগর গ্রামে গঙ্গা পন্ডিতের কাছে পড়তে পড়তেই তীক্ষ্ণ মেধার সাক্ষর রাখেন ৷ তাঁর
পান্ডিত্যের কাছে সেকালের তাবড় পন্ডিত হার মেনেছেন ৷ ছোট থেকে জাতি , বর্ণ , বিত্ত নির্বিশেষে সবার সঙ্গে প্রাণখুলে মিশতেন ৷ সেকালের অনুশাসন উপেক্ষা সবার বাড়ী যেতেন ৷১৬ বছরের কিশোর গোরার এভাবে ভালো লাগে বল্লভ আচার্যের ১১ বছরের কন্যা লক্ষ্মীপ্রিয়াকে ৷ গরিব ব্রাহ্মণ শ্বশুর
মশাইয়ের কাছে মাত্র পাঁচটি হরীতকী নিয়ে তিনি
লক্ষ্মীকে ঘরে আনেন ৷ বিয়ের পর বিশ্বম্ভর নবদ্বীপে নিজের টোল খোলেন ৷ এরপর শচীমাতা সদ্য বিবাহিত নিমাইকে নিয়ে যান শ্রীহট্ট ( সিলেট) – র ঢাকা দক্ষিণ গ্রামে ঠার্কুদার আর্শীবাদ আনতে ও সম্পত্তি বিক্রি করতে ৷ তখন হেঁটে আর গোরুর গাড়ীতে অতদূর যাতায়াতে দু মাস লেগেছিল ৷ এসে শোনেন তাঁর প্রাণপ্রিয় পত্নী সাপের কামড়ে মারা গেছেন ৷ তাঁর
স্বল্প বিবাহিত ঐ জীবনের গল্প তাই অনেকটা ঢাকা
পড়ে গেছে ৷ নিমাইয়ের জীবনের প্রথম কুড়ি বছর
নিয়ে তাঁর পান্ডিত্য ও কুসংস্কার মুক্ত জীবন কথা ছাড়া বেশী কিছুর খোঁজ মেলে না ৷ ঐ সময় নিয়ে সুন্দর কেশের হলুদ বর্ণের বিশ্বম্ভর বা চৈতন্যকে নিয়ে কয়েক বছর আগে একটা নাটক দেখেছিলাম ৷ লক্ষ্মীপ্রিয়ার জন্মভিটায় এসে আজ মনে পড়ছিল
“দ্রোহী চৈতন্য” নাটকটির কথা ৷ “হযবরল” প্রযোজিত চন্দন সেন পরিচালিত ঐ নাটকটিতে তাঁর প্রথমা স্ত্রীর অনালোকিত কাহিনী তুলে ধরা হয়েছিল ৷ বৃন্দাবন দাসের “চৈতন্য ভাগবত ” এবং মুরারী গুপ্তের ১৫১৩ সালে লেখা “শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য চরিতামৃতে” এবং চূড়ামণি দাসের “গৌরাঙ্গ বিজয় ” বইতে লক্ষ্মীপ্রিয়ার কথা পড়েছি ৷ কেউ কেউ বলেছেন স্বামী দূরে যাওয়ায় “বিরহ সর্পের কামড়ে ” অর্থাৎ অন্নজল ত্যাগ করে লক্ষ্মীপ্রিয়ার মৃত্যু হয় ৷ “প্রভুর বিরহ -সর্প লক্ষ্মীরে দংশিল ৷/
বিরহ-সর্প-বিষে তার পরলোক হৈল ৷৷”( শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত, আদিলীলা ,১৬/২১) ৷ ” ঈশ্বর বিচ্ছেদ লক্ষ্মী না পারে সহিতে ৷/ ইচ্ছা করিলেন প্রভুর সমীপে যাইতে ৷৷/ নিজ -প্রতিকৃতি -দেহ থুই পৃথিবীতে ৷/ চলিলেন প্রভু পাশে অতি অলক্ষিতে ৷৷”( শ্রীচৈতন্যভাগবত , আদিখন্ড, ১৪/১০৩-১০৪)” ” প্রভু না দেখিয়া লক্ষ্মী কাতর- অন্তর ৷/ প্রভুর বিরহ তার স্ফুরে নিরন্তর ৷৷/ বিরহ হৈল মূর্ত্তি সর্পের আকার ৷/ লক্ষ্মী ঠাকুরাণী তাহা জানিল অন্তর ৷৷” মহাপ্রভুর বিরহজ্বালা কাতর লক্ষ্মীপ্রিয়া গৌরাঙ্গের চরণযুগল ধ্যান করতে করতে বৈকুন্ঠে নিত্যপতির সেবার সেবার্থে ধরাধাম থেকে বিদায় নেন ৷ অবশ্য সর্পদংশন রূপক হতে পারে ৷ তবে , সেসময়ে কেন এখনও নবদ্বীপে সাপের উপদ্রব কম নয় ৷ তখন চিকিৎসা ছিল না ৷
অনেক ক্ষেত্রে সাপে কাটলে সময়ও পাওয়া যায় না ৷ শচীমাতা জ্ঞানী মহিলা ৷ বিশিষ্ট সিলেটি ব্রাহ্মণ নীলাম্বর চক্রবর্তীর কন্যা ৷ সন্তানের ভালো সব মায়ের মত তিনিও চাইতেন ৷ তাই ,লক্ষ্মীপ্রিয়ার এই মৃত্যু নিয়ে জলঘোলা তাঁকে হেয় করা মনে হয়েছে ৷
বিশেষ করে ঐ সময় শচীমাতার বড় ছেলে বিশ্বরূপ “শঙ্করারণ্য” নাম নিয়ে সন্ন্যাসব্রত নিয়েছেন ৷ ভগবান যখনই ধরাধামে আসেন তখন অবর্তীণ হন ভগবৎশক্তি ৷ভগবৎশক্তি লক্ষ্মীপ্রিয়া ও বিষ্ণুপ্রিয়ার অপ্রাকৃত বিরহলীলা বুঝতে চাই শুদ্ধ ভক্তি ৷ হিন্দু ধর্মের নানা কথা বিশদে জানতে আমার লেখা “সনাতনী কৃষ্টিকথা ” ও ” হিন্দু ধর্ম” বই দুটি পড়ুন ও পড়ান ৷ বৈকুন্ঠলক্ষ্মী রুক্মিণী লক্ষ্মীপ্রিয়া ভৌমলীলা সংবরন করে নারায়ণের ধ্যান করতে করতে বৈকুন্ঠধামে উন্নীত হন ৷ দ্বারকালক্ষ্মী সত্যভামা কলিযুগে বিষ্ণুপ্রিয়া হয়ে গৌরহরির নাম স্মরণ , অর্চন , কীর্তনের শিক্ষা ছড়িয়ে দেন ৷
“দ্বারকায় কৃষ্ণপ্রিয়া ছিলেন রুক্মিণী ৷/ কলিকালে লক্ষ্মীপ্রিয়া গৌরাঙ্গ ঘরণী ৷/ আর সত্যভামা বিষ্ণুপ্রিয়া নাম ধরে ৷/ বৈষ্ণবজননী হন গৌরাঙ্গের ঘরে ৷” ৷জয় লক্ষ্মীপ্রিয়া শ্রীচৈতন্য বল্লভে ৷ হরে কৃষ্ণ ৷
Be First to Comment