Press "Enter" to skip to content

গোলাপ খাস আমের হলুদ গায়ে আলতার রং আমার শরীরে শিহরন জাগায়। কোনো আমসুন্দরীর কথা মনে পড়ায়…..।

Spread the love

আম্রপালি

ভাস্কর ভট্টাচার্য : কলকাতা, ৫ জুন ২০২১। আমের নাম কালাপাহাড়!! আমি হতবাক। এমন আবার আমের নাম আছে নাকি? হিমসাগর, ল্যাংড়া, মুম্বই , মধুগুলগুলি , গোলাপ খাস, আম্রপালি , সুরমা ফুলি অনেক নাম শুনেছি, তাই বলে ইতিহাসের এক দুর্ধ্বর্ষ কালান্তক ব্যক্তির নামে আম!! থতমত খেলাম দোকানির জোরালো সওয়ালে। সে জোর দিয়েই বলল। হাতের কাছে কোনো লোক পেলাম না যিনি বলতে পারেন এমন নামের আম আছে কি না।

মনে পড়ল কত কথা।

যত ক্রেতা , তত বিক্রেতা। যে দিকে তাকাই, সে দিকেই আম। হঠাৎ এত আমওয়ালা দেখে ভাবছিলাম এ বছর বোধ হয় আমের ফলন বেশি । পরে বিষয়টা অনুধাবন করেছি। লকডাউন। রুজির টানে অনেকেই নেমেছেন আম ব্যবসায়।
আম আমার প্রিয়। তাই যেখানেই যাই প্রথমেই খোঁজ করি আম গাছ আছে কি না। আর কিছুই নয়। আমের একটা নেশা ধরানোর ক্ষমতা আছে। আর যে – কোনো নেশার জিনিসের প্রতি আমার গভীর টান। আমের পাতায় যত রং, তত শিহরন।
আমের বৌলয়ের রং , পাতার রং, সবুজ থেকে লাল হলুদ রং পাল্টানোর রূপান্তর যার চোখে পড়েনি, সে আমের নেশার কথা বুঝতে পারবে না। গোলাপ খাস আমের হলুদ গায়ে আলতার রং আমার শরীরে শিহরন জাগায়। কোনো আমসুন্দরীর কথা মনে পড়ায়। মনে পড়ল বিখ্যাত চিত্রকর পরিতোষ সেন ‘আমসুন্দরী’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। যদিও সেটা আম বিষয়ক নয়। তবে মিষ্টি গদ্যে লেখা বই।

রবীন্দ্রনাথের সেই ছড়াটার কথা মনে এল ‘ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল, ডালে ডালে কুঞ্জিত আম্র মুকুল।’ ‘ জৈষ্ঠ্যের ঝড়ে আমকুড়োনোর ধুমের কথাও। শুধু কি রবীন্দ্রনাথ? বিভূতিভূষণের ‘আম আঁটির ভেপু’ ? আমের আঁটিকে বাঁশি করে বাজানোর কথা? সুকুমার রায়ের সেই বিখ্যাত লাইন ‘ ‘আম পাকে বৈশাখে… থেকে শুরু করে মুগল সম্রাটের রাজদরবারে আম ‘ ভেট’ পাঠানোর কথা। একালে আজও জামাই আদরের মহা আদরণীয় ‘ভেট’ হল আম। আম আদমি, আম দরবার, ‘খুলে আম’ । আম নিয়ে কত কথাই মনে আসছে। গত বছর হয়ে গেল ভয়ানক এক ঝড়। একটা বিধ্বংসী ঝড়ের নাম ‘ আমফান’ , ভাবা যায়?

এই তো সেদিন এক ফেসবুক বান্ধবীকে কথার ফাঁকেই প্রশ্ন করলাম তোমাদের আম গাছ আছে? ও বলল, হ্যাঁ। ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল কেন বলো তো ? আমি নিশ্চুপ ছিলাম।

আম আমার কাছে রোমান্সে ভরা ফল । এত রং পাল্টানো, এত রমণীয়, রসালো‌ সুস্বাদু যে তাকে তারিয়ে তারিয়ে আস্বাদন করতে হয়। এত মোলায়েম এর তৃপ্তি। জিভের মধ্য দিয়ে ক্ষরিত প্রবাহিত হয় এক ধরনের আম্রসুখ।

সারি সারি সাজানো সোনালি আমের দিকে তাকালেই আমার খুব কয়েকজন প্রিয় মানুষের কথা মনে পড়ে। তাঁরা সবাইই রহস্যে রোমাঞ্চে ভরা মানুষ। তাঁদের রকমারি আম বিলাসিতার কথা আজও চোখে ভাসে।

পি থনকপ্পন নায়ার নামে এক কলকাতা প্রেমী কেরালিয়ান গবেষক দীর্ঘ চার দশক কলকাতায় কাটিয়ে গেছেন। সম্প্রতি তিনি কলকাতার পাঠ চুকিয়ে স্বভূমিতে ফিরে গেছেন। তিনি ছিলেন কলকাতা বিষয়ক গবেষক। হরেক বিষয় নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি এমনকী ইন্ডোলজির মতো বই লেখার পাশাপাশি শুধুমাত্র আম নিয়ে আস্ত একটা বই লিখে ফেলেছিলেন! সেখানেই দেখেছিলাম সারা পৃথিবীতে নাকি আড়াই হাজার প্রজাতির আম রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটার নাম আমরা জানি।

এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার গভীর যোগাযোগ ছিল। তাঁর ভবানীপুর কাঁসারি পাড়ার বাড়িতে বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম। অত্যন্ত সময়সচেতন মানুষ ছিলেন। আমার মতো হিসেবহীন মানুষ একদম পছন্দ না করলেও আমাকে কেন পছন্দ করতেন জানি না। তাঁর লেখা আমের বইয়ের কথা জানতামই না। হঠাৎ একদিন কলকাতার বইপাড়ায় মধ্যাহ্নে আচমকা দেখা হয়ে যায়। উনি কথা বলতে বলতে হঠাৎ পুরনো বইয়ের তাকে আঙুল দিয়ে দেখালেন এবং প্রশ্ন করেন,, ‘হ্যাভ ইউ সিন দিস বুক? দিস বুক ইস মাইন।’ তাকিয়ে দেখি আম নিয়ে লেখা গোটা একটা বই। সেখানেই পেয়েছিলাম আমের সালতামামি। পাতায় পাতায় আম নিয়ে অনেক খবর।

থনকপ্পনকে যেমন ভুলব না তেমনি ভুলব না বিদুষী কল্যাণী দত্তকে। এমন বইপিপাসু, গ্রন্থভুক মানুষ কম দেখেছি। কল্যাণীদি একটা কলেজের শিক্ষিকা ছিলেন। তাঁর বই সংগ্রহের কথা আগে অনেক লিখেছি। আজ তাঁর আম প্রীতির কথাই শুধু বলব। তাঁর সঙ্গেও আমার ছিল আন্তরিক সম্পর্ক। আমার বিপদের দিনের একজন হিতাকাঙ্ক্ষী মানুষ।
তখন তাঁর বিখ্যাত ‘থোড় বড়ি খাড়া’ বইয়ের মুদ্রণের কাজ প্রায় শেষ। আমাকে পড়ে শোনাতেন। আরও বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই লিখে গেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উনিশ শতকের বৈধব্য নারীর অশ্রুসজল একটি বই। কল্যাণীদি আমার আমরণ স্মৃতি।

একদিন হঠাৎ কথা বলতে বলতে বললেন, চলো তোমায় একটা জিনিস দেখাই। অশক্ত শরীরের অনুগামী আমি। একটা বিশাল ঘর একদিকে অসংখ্য বই, অন্যদিকে পাখার নীচে তুলোয় মোড়া বেশ কিছু সুদৃশ্য আম। রাজকুমারীর চিবুকের মতো রং। দেখিয়ে বললেন, অনেক কষ্ট করে আনিয়েছি। খুব সুখের আম। যত্নে না রাখলে থাকে না। তাই চব্বিশঘণ্টা পাখার তলায় রেখেছি। না হলে নষ্ট হয়ে হয়ে যাবে। সেদিন প্রথম আলফানসো আমের স্বাদ পেয়েছিলাম। শৌখিন ডিসের মধ্যে হৃদয় হরণ করা অমন নরম সুরঙা আমের স্বাদ নিতে নিতে হারিয়ে যাওয়া বান্ধবী শেলির চিবুকের কথা মনে পড়েছিল।

আম নিয়ে হুড়মুড়িয়ে অনেক কথা ভিড় করে আসছে। অনেক ছোটবেলায় এক বন্ধুর বাড়িতে রথের দিন আমাদের সবাইকে আম খেতে দিয়েছিলেন বন্ধুর মা। ওদের বাড়িতে মহা ধুমধাম করে ‘রথ পুজো’ হত। কাকিমা সবাইকে জিজ্ঞাসা করছেন আরেকটা আম নেব কিনা। সবাই না বলেছিল। আমি শুধু হ্যাঁ বলেছিলাম। সেদিন পাশে বসা সহোদর দাদা বলেছিল, মাকে বলে দেব, তুই চেয়ে খেয়েছিস। সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম চেয়ে খাওয়া অপরাধ, অসভ্যতামি। যদিও জীবন থেকে অসভ্যতামি দূর করতে পারিনি। মোনালিসার ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে অনুমতি চেয়ে নিতে হয়েছিল।

জীবন থেকে কী করে যে দিনগুলো চলে গেছে টের পাইনি।

আম আজও আমার প্রিয়। খাই, না খাই দেখলেই মনে হয় কিনি। এমন রসাল প্রেম আর কোন ফলে মেলে? কত যে স্মৃতি!
প্রকৃত গাছ পাকা আমের স্বাদের মাধুর্য উপহার দিয়েছিল সুজয়ের প্রেমিকা। কলেজ জীবনে একদিন হঠাৎ ব্যাগ থেকে‌ দুটো‌ আম বের করে বলেছিল, ‘তোর জন্য এনেছি’ । আমাদের গাছের গাছপাকা হিমসাগর। খেলে কোনোদিন ভুলবি না।”
সত্যিই ভুলিনি। সুজয় পৌষালী দুজনেই এখন ম্যাসাচুসেটস এর স্থায়ী বাসিন্দা। কোনোদিন আর ফিরবে না হয়তো‌ এই পোড়া বন্ধুর দেশে। তবে আমাকে দিয়ে গেছে এক অনন্য স্বাদের স্মৃতি। ওরা কি আম খায়? পৌষালীদের সেই বিশাল আমবাগান ঘেরা বাড়ি কি আর আছে? কে জানে।
স্মৃতি অনেকটা রবারের মতো। টানলে বাড়তেই থাকে। আমের কথা বলে শেষ করা যায় না।
এই একটা বস্তু যে আমির আমিত্বের গৌরব নিয়ে‌ সারা বছর ঘরে ঘরে বিরাজ করে। কখনো আমতেল হয়ে, কখনো আচার বা আমচুর রূপে বয়াম বন্দি হয়ে রান্নাঘরের তাকে। সারা বছর এক আদরণীয় আকর্ষণ নিয়ে সংসারের সঙ্গী। রমণীর হাতের বাহারী প্রেম প্রগলভতা।

জাতীয় ফল আম দৌত্যের দূতও বটে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে পদ্মার ইলিশ পাঠালে এ পার থেকে রাজকীয় রাষ্ট্রীয় সম্মানে উড়ে যায় মালদার আম।
মনে মনে ভাবি ধান বা চালের পাশাপাশি পৃথিবীতে এই একটা ফল যা বিশ্বের সব প্রান্তেই মনে হয় কম বেশি পাওয়া যায়। আর আমের এত প্রজাতি এত নাম বিশ্বে আর কোনো ফলের বোধহয় নেই। তা না হলে ” কালাপাহাড়”? কালাপাহাড়ের কাহিনি জানা থাকলে মুখে এ আম রুচলে হয়।

এই তো সেদিন। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম গাছটার দিকে। ফলভারে নুয়ে পড়েছে গাছটি। এমন ঋতুমতী গাছের দিকে না তাকিয়ে থাকা যায়? সারা শরীরে কত রং। কত আম।
মিতা বলল, কি দেখছ? আমি বললাম, তোমায়। মিতা বলল, সব সময় হেঁয়ালি। আমি বললাম, ওই আমগাছটার মতোই তুমি। কত ঝড়, কত ঝঞ্ঝা সামলে এমন রসাল উপহারের ডালি সাজিয়েছে।
তোমার হাসিটাও ঠিক তেমনি। বোঝাই যায় না কত ঝড় সামলে তুমি আজও এমন হাসতে পারো।
মুখ বেঁকিয়ে প্রগলভ এক দৃষ্টি নিয়ে নীচে নেমে গেল মিতা। আমি একা ছাদে আম্রপালিকে দেখতে লাগলাম।

আম্রপালি। কী সুন্দর নাম।

ভাস্কর ভট্টাচার্য

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.