Press "Enter" to skip to content

গালিব মাত্র নয় বছর বয়সে ফার্সিতে শের, কবিতা, গজল লেখা শুরু করেন। গালিব মদ পান করার সময় লিখতেন এবং তা প্রায়ই সন্ধ্যায়৷ মদ হাতে, একা বসে একটি সুতা নিয়ে খেলতেন, কবিতার একটি লাইন লেখার পর সুতায় একটি গিঁট দিতেন………..।

Spread the love

জন্মদিনে স্মরণঃ মির্জা গালিব

তাঁর আসল নাম মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ খান। ‘গালিব’ তাঁর ছদ্ম নাম। এর আগে তিনি ‘আসাদ’ ছদ্মনামে লেখালিখি করতেন। ‘আসাদ’ শব্দের অর্থ- সিংহ আর ‘গালিব’ শব্দের অর্থ- সর্বশ্রেষ্ঠ, বিজেতা। নামের মতোই তিনি ছিলেন তেজি, দাম্ভিক আর শের স্রষ্টায় শ্রেষ্ঠ।

যুক্তিবিদ্যা, জ্যোর্তিবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনা করলেও তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি। তিনি উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি হলেও ফারসি ভাষার প্রতি গালিব ছিলেন অত্যানুরাগী এবং এ ভাষায় তাঁর দখল ছিল ঈর্ষনীয়।

উপনিবেশিক পরাধীনতার মাঝে গালিবের জন্ম, গালিবের বাবা মির্জা আব্দুল্লাহ বেগ খান এবং চাচা মির্জা নাসিরুল্লাহ বেগ খান দু’জনেই যখন যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিক হিসেবে নিহত হয়েছিলেন তখন গালিব নেহাত একজন শিশু।

১৮১০ সালে তের বছরের কম বয়সে গালিব নওয়াব ইলাহী বখশ খানের কন্যা ওমরাও বেগমকে বিয়ে করেন। বিবাহিত জীবনে সাত সন্তানের জনক হলেও তাঁর একটি সন্তানও বাঁচেনি।

গালিবের শের এর ছত্রে ছত্রেও এই দুঃখবোধ, অভাব, আর অপ্রাপ্তির অভিযোগ বারংবার ফুটে উঠেছে। তেমনি এক শের এ গালিব বলছেন- ‘দিল হি তো হ্যায়, না সংগ ও খিস্ত, দর্দসে ভর না আয়ে কিউ/রোয়েংগে হাম হাজার বার, কোই হামেঁ সাতায়ে কিউ।’ অর্থাৎ, ‘এটাতো আমার মন, ইট পাথরতো নয়, বেদনায় ভরবে না কেন?/ আমি কাঁদবো হাজারবার, কেউ আমায় উত্যক্ত করে (কাঁদায়) কেন?’

গালিব মাত্র নয় বছর বয়সে ফার্সিতে শের, কবিতা, গজল লেখা শুরু করেন। গালিবের লেখার অভ্যেস ছিল অদ্ভুত। গালিব মদ পান করার সময় লিখতেন এবং তা প্রায়ই সন্ধ্যায়৷ মদ হাতে, একা বসে একটি সুতা নিয়ে খেলতেন, কবিতার একটি লাইন লেখার পর সুতায় একটি গিঁট দিতেন। যখন শুতে যেতেন, তখন সুতায় অনেকগুলো গিঁট থাকতো। সকালে তিনি গিঁটগুলো খুলতেন৷ লাইনগুলো তিনি মুখস্থও বলতে পারতেন।

গালিব শুধুই একজন কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন গভীর দার্শনিক, ভাবুক এবং চিন্তাশিল্পী। গালিবের কাব্যে রাজনৈতিক চেতনা নেই, বা প্রায় অনুপস্থিত।

তাঁর কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে নিজের অহংকার এতো প্রচন্ড ছিল যে, তিনি মনে করতেন খুব কম লোকই তার কবিতাকে বিচার করতে সক্ষম৷ গভীর হতাশায় গালিবকে তাই উচ্চারণ করতে শুনি- ‘ইয়া রব, ও না সামঝে হ্যায় না সামঝেংগী মেরী বাত/দে অর দিল উনকো জো না দে মুঝকো জবান অর।’ অর্থাৎ, ‘হে খোদা, সে না বুঝতে পারে আমাকে, না বুঝতে পারে আমার কথা/তাকে দাও ভিন্ন হৃদয়, অথবা আমাকে দাও ভিন্ন বাচনভঙ্গি।’

উর্দু আর ফার্সি সাহিত্যে শুধুমাত্র কবিতা, শের বা গজলে গালিবের অবদান ছিল তা নয়। গদ্য সাহিত্যেও বিশেষতঃ চিঠি লেখায় তিনি এক বিশেষ রীতির জন্ম দেন। তাঁর রচিত “দাস্তাম্বু” রোজনামচা বা দিনলিপি তাঁর গদ্য সাহিত্যের এক অনবদ্য সৃষ্টি যা একই সঙ্গে ১৮৫৭ সালে সংঘটিত সিপাহী বিদ্রোহ এবং ব্রিটিশ কর্তৃক তা নির্মমভাবে দমনের এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে আছে।

গালিব শুধু কবিতার জন্যই বিখ্যাত ছিলেন না, বিখ্যাত ছিলেন তাঁর দাম্ভিকতা, আভিজাত্যবোধ, বেপরোয়া প্রথাবিরোধী জীবনযাপন এবং সুরা, সাকী আর জুয়ার প্রতি তীব্র আসক্তির জন্য। সুরার প্রতি আসক্তিকে গালিব মনে করতেন আশির্বাদ, জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং কবিত্বের শক্তি৷ নিষিদ্ধ জুয়া খেলার জন্য ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক একবার কারাভোগও করেছিলেন তিনি।

গালিব ছিলেন নারীসঙ্গ প্রিয়, বহুগামী, ভোগবাদী এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে তাঁর বিশেষ নিষ্ঠা ছিল না৷ অবশ্য এ নিয়ে তাঁর কোন রাখডাকও ছিল না। ‘খাও, পান করো এবং খুশি থাকো’ কিংবা ‘বুদ্ধিমান মাছি চিনির ওপরে বসে; মধুর ওপরে নয়’- গালিবের এই উক্তি একসময় প্রবাদে পরিণত হয়।

শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, যিনি নিজেও একজন উঁচুমানের শায়ের ছিলেন, তিনি মির্জা গালিবকে সভাকবির মর্যাদা দিয়েছিলেন। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, গালিবকে ‘নজ্‌ম-উদ্‌-দৌল্লা, দবীর-উল-মুলক, নিজাম জঙ্গ, অর্থাৎ সাম্রাজ্যের তারকা, দেশের শ্রেষ্ঠ কবি, যুদ্ধের গরবী নায়ক’- উপাধিতে ভূষিত করেন ১৮৫০ সালে।

কেবল খেতাবই দেননি, মীর্জা গালিবকে নিজের ‘মুরশিদ’ বলেও মেনে নিয়েছিলেন। ‘মুরশিদ’— মানে দর্শনগুরু বা ওস্তাদ কিংবা ‘আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক’।

আশ্চর্য খেয়ালী এই শিল্পী কখনো অর্থের জন্য কাজ করেন নি। তাঁর জীবিকা নির্বাহ হয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অথবা ধার কর্জ করে নতুবা কোনো বন্ধুর দানে।

চরম আর্থিক দারিদ্র্য আর দুরাবস্থার মধ্যে ১৮৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গালিব ইন্তেকাল করেন এবং তাকে দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারের কাছে পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করা হয়৷

মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ খান ওরফে মির্জা গালিব ১৭৯৭ সালের আজকের দিনে (২৭ ডিসেম্বর) আগ্রায় জন্মগ্রহণ করেন।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.