জন্মদিনে স্মরণঃ সি মো ন দ্য বো ভো য়া র
“কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, বরং নারী হয়ে ওঠে।”
———- সিমোন দ্য বোভোয়ার
বাবলু ভট্টাচার্য : বিশ শতকের প্রথমার্ধে যখন নারীমুক্তির কথা প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে, যখন বড়ো করে তোলা হচ্ছে নারীর ‘শাশ্বত রূপ’কে, প্রচেষ্টা চলছে নারীকে আবারও শুধুই সংসারে আবদ্ধ করে রাখার, তখন সেই অন্ধকার ভেদ করে ভোরের আলোর মতো উদিত হয় সিমোন দ্য বোভোয়ারের ‘ল্য দ্যজিয়ম সেক্স’ বা ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বা ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ গ্রন্থটি।
বাবা জর্জে বেরত্রা দ্য বোভোয়ার ছিলেন পেশায় আইনজীবী এবং ধর্মীয় প্রশ্নে সন্দেহবাদী এবং একাধারে প্যারিসিও বিশ্ব নাগরিক। অন্যদিকে মা ফ্রাঁসোয়া ব্রাসেয়ো ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক। দু’বোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সন্তান সিমোন বোভোয়ারকে অনেকটা পুত্রের মতো করেই বড় করেছেন তাঁর বাবা। কারণ তিনি মনে করতেন পুরুষের মগজ সিমোনের এবং সে চিন্তাও করে ‘পুরুষের মতো’।
ছোটবেলা থেকেই নিজের চারপাশকে বুঝতে শুরু করেছিলেন সিমোন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে উঠলে সিমোন দেখতে পান উদয়াস্ত কী দুঃসহ ক্লান্তিকর গৃহস্থালির কাজ করতে হয় তাঁর মাকে। এই ক্লান্তির মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন তিনি দ্বিতীয় লিঙ্গ গ্রন্থে। মা আর অন্য নারীদের গৃহকর্মে বাঁধা জীবন আতঙ্কিত করে সিমোনকে।
সিমোনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভও ঘটেছে প্যারিসে। ১৯২৯ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে সর্বনে। দর্শনে এগ্রিগেশন পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি এবং এ পর্যন্ত ফ্রান্সে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এই ডিগ্রিধারী হন। পরীক্ষায় জাঁ-পল সার্ত্র হন প্রথম আর সিমোন দ্বিতীয়। ফলে গড়ে ওঠে দু’জনের বন্ধুত্ব— যা রূপ নেয় এক ব্যতিক্রমী প্রেমের সম্পর্কে।
১৯৩০-এর দশকের জন্য যদিও তাঁদের এই সম্পর্ক সমাজের চোখে ছিল খুবই অপ্রথাগত। কেননা তাঁরা একসাথেও থাকতেন না, আবার ‘লিভ টুগেদার’-ও করতেন না। বিয়ে করে একসঙ্গে থাকা আর্থিকভাবে সুবিধাজনক মনে হলেও তাঁরা এ পথ বেছে নেননি, কারণ তাদের মনে হয়েছে বিয়ে এমনকি একত্র বাস মানুষের জন্য ক্ষতিকর, যেহেতু এ ব্যবস্থায় একজন হয়ে উঠতে চায় ‘কর্তা’ আর অপরজনকে পরিণত করতে চায় ‘কর্মে’।
বিশ শতকের অন্যতম এই দুই দার্শনিক পরস্পরকে প্রভাবিত করেছেন প্রচণ্ডভাবে নিজ নিজ চিন্তা ও কাজের দ্বারা। অবিবাহিত সন্তানহীন সিমোন আমরণ ডুবেছিলেন সার্ত্রের গভীর বন্ধুত্বে— যদিও অন্য প্রেমের কাছেও তিনি ধরা দিয়েছেন মাঝে মধ্যে।
জীবিকার জন্য মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন সিমোন দ্য বোভোয়ার আর নিজের মধ্যে মিলিয়েছেন কর্ম ও জ্ঞানকে। ফ্রান্সের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ও নানা অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংঘটিত সংগ্রামের কেন্দ্রেও ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। তাঁর লেখা উপন্যাসগুলোর মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, লেখকদের কীভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে হয় সময়ের কাছে।
তাঁর যুগান্তকারী ‘ল্য দ্যাজিয়ম’, বাংলায় যা ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ বইটি পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতায় নারীর পরিস্থিতির এক ধ্রুপদী দার্শনিক, সমাজতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক ভাষ্য। ‘চিরন্তনী নারী’র ধারণা পিতৃতন্ত্রের ধর্মে, দর্শনে, সাহিত্যে এবং অন্য সবকিছুতে এক ধ্রুব ব্যাপার বলে গৃহীত, কিন্তু সিমোন ধর্ম, পুরান, মনোবিজ্ঞান, সাহিত্য ঘেঁটে তার অসারত্ব তুলে ধরেন। ভাষার শিল্পীত সৌন্দর্য ও লেখকের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ‘ল্য দ্যজিয়ম’ (সেকেন্ড সেক্স) হয়ে ওঠে আধুনিক নারীবাদের মূলগ্রন্থ।
তিনি বলেছেন— ‘স্ত্রীলিঙ্গ তার প্রজাতির শিকার’, কারণ প্রজননের মাধ্যমে কেউ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে হয় সৃষ্টি ও নির্মাণের মধ্য দিয়ে। পুরুষ চেষ্টা করে নিজের জন্য অধিকতর স্বাধীনতা সৃষ্টির কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সে নারীকে বঞ্চিত করেছে আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাভিলাসের অধিকার থেকে। নারীকে তাই ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে দেয়া হয়নি। সিমোন তাই ‘চিরন্তনী নারীত্ব’কে বাতিল করে নারীর জন্য চেয়েছেন পুরুষের গুণ। তিনি চেয়েছেন নারী ও পুরুষের সাম্য ও প্রীতিপূর্ণ বিকাশ।
‘ল্য দ্যজিয়ম’-এর পর সিমোন লেখেন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘লে মাঁদারে’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফরাসি বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে তাদের ‘ম্যান্ডারিন’ মর্যাদা বা অভিজাত অবস্থান ছেড়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন— উপন্যাসটি তারই বিবরণ। উপন্যাস ছাড়াও সিমোন লিখেছেন ভ্রমণকাহিনী। ৪টি আত্মজৈবনিক বই এবং অসংখ্য প্রবন্ধ।
প্রচলিত অর্থে তিনি নিজেকে নারীবাদী বলতে নারাজ ছিলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করেছেন যে সমাজতন্ত্রের বিকাশের সাথে সাথে আপনাআপনি সমাধান হয়ে যাবে নারীর সমস্যা। অতএব তাঁর সংজ্ঞার নারীবাদী বলতে সেই নারী বা পুরুষকে বোঝায় যিনি সংগ্রাম করছেন নারীর অবস্থা বদলের জন্য, যার সাথে থাকছে শ্রেণীসংগ্রাম এবং যাঁরা শ্রেণীসংগ্রাম নিরপেক্ষভাবেও, সমাজের অন্য যে কোন বদলের ওপর নির্ভর না করেও নারীর অবস্থা বদলের জন্য সংগ্রাম করতে পারেন।
সিমোন দ্য বোভোয়ার ১৯০৮ সালের আজকের দিনে (৯ জানুয়ারি) ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment