জন্মদিনে স্মরণঃ মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
বাবলু ভট্টাচার্য : বাড়িতে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, বড়ে গোলাম আলিদের আনাগোনা। জ্ঞানপ্রকাশের ডিক্সন লেনের বাড়িতে যাতায়াত, বেগম আখতার কলকাতায় এলেই হত্যে দেওয়া, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলি আকবর খান, পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর সংস্পর্শে আসা, সেতারবাদক নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুতা— সব মিলিয়ে সুরের রামধনুতে যাঁর চলাচল, তিনি মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
ঠাকুর্দা গজেন্দ্রনাথ ছিলেন অসম্ভব সঙ্গীতরসিক মানুষ। রজনীকান্ত সেনের সঙ্গে একই মেসে থাকতেন। নিজে ভক্তিগীতি, হরিনামের গান গাইতেন। রজনীকান্ত গান লিখে গজেন্দ্রনাথকে দেখাতেন।
বাংলাদেশের বরিশালের উজিরপুরে ওঁদের যে দেশের বাড়ি, তার চণ্ডীমণ্ডপে গান লেগেই থাকত। রাধাকৃষ্ণের লীলাকীর্তন, রয়ানী গান, মনসামঙ্গলের আসর…। মাঝিমাল্লারাও গান গাইত। সারিন্দা বাজিয়ে। সারিজারি ভাটিয়ালি— ‘আর কত দিন রইব দয়াল/নেবানি আমায়’। নমঃশুদ্র মাঝিরা গাইত হরে নামসংকীর্তন।
বাবা অতুলচন্দ্র গানবাজনা না করলেও, তাঁরই উৎসাহে দুই কাকা রত্নেশ্বর আর সিদ্ধেশ্বর গানচর্চা করতেন। ওঁরাই ছিলেন ‘মুখুজ্জে পরিবার’-এ কীর্তন, ধ্রুপদী গানের বাহক।
কাকা রত্নেশ্বরের ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধু। কিশোর মানবেন্দ্রর কীর্তনে মুগ্ধ হয়ে নজরুল নিজে দু’টি গান শিখিয়ে দিয়েছিলেন— ‘সখী সাজায়ে রাখ লো পুষ্পবাসর’ আর ‘হে মাধব হে মাধব’।
সেই নজরুলকে এক সময় বাঙালি যেন ভুলতে বসল! এই বিস্মরণ ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের। ঠিক করেছিলেন যেখানেই অনুষ্ঠানে যাবেন, নজরুলের গান গাইবেন।
এ দিকে সবাই তখন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ফিল্মি গান, আধুনিক গান শুনতে চায়। পরের পর অনুষ্ঠানে গিয়ে ঝামেলায় জড়িয়েছেন। উঠে চলেও এসেছেন। তবু ছাড়েননি নজরুলের গান!
গ্রামাফোন কোম্পানিতে রেকর্ডিং অফিসার হয়ে এলেন সন্তোষকুমার সেনগুপ্ত। ডেকে পাঠালেন মানবেন্দ্রকে। নজরুলের প্রতি অবজ্ঞা তাঁকেও বিঁধছিল। ‘বেস্ট লভ সঙস অব নজরুল’ এলপি করবেন তিনি। তাতে দুটি গান গাইলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়— ‘এত জল ও কাজল চোখে’ আর ‘বউ কথা কও’। এত বিক্রি হল যে কোম্পানি স্পেশাল ইপি করতে ডাকলেন। লেবেলে লেখা হল ‘নজরুল গীতি’।
কলেজজীবনে আদর্শ ছিলেন গায়ক-অভিনেতা রবীন মজুমদার। মজা করে কবুলও করতেন- ‘‘ওঁর দেখাদেখিই সরু গোঁফ রাখতে শুরু করি। পঞ্চাশের দশকে যখন রবীন মজুমদার পড়তির দিকে, কারা যেন বলেছিল, মানব, জায়গাটা খালি হলে কিন্তু তোর একটা চান্স হবে। সেই আশাতেই ‘সাড়ে ৭৪’-এ নামলাম। সেই প্রথম, সেই শেষ।’’
সিনেমায় আর অভিনয় করেননি। কিন্তু খুব শখ ছিল মিউজিক্যাল বায়োস্কোপে। সেই জন্যই বন্ধু শ্যামল গুপ্তকে নিয়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ‘জলসাঘর’ কাহিনিটি কিনেছিলেন পাঁচশো টাকা দিয়ে। ছবি করবেন। কিন্তু সে আর কিছুতেই হল না! পরে সত্যজিৎ রায় করেছিলেন ছবিটি।
রাগপ্রধান বাংলাগান এবং নজরুলসংগীতের জন্যই শুধু তিনি বাংলা সংগীত জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বাঙালি শ্রোতা তাঁকে মনে রাখবে বহু চলচ্চিত্রে তাঁর অনন্যসাধারণ সুর সৃষ্টির জন্যেও।
‘মায়ামৃগ’ ছবিতে তাঁর গাওয়া ‘ক্ষতি কি না হয় আজ পড়বে মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য’ কিংবা ‘জয় জয়ন্তি’ ছবির সেই অবিস্মরণীয় গান— ‘খাব খাব করছে আমার পাগল মন’। ১৯৫৪ সালে সুধীরলাল চক্রবর্তীর সুরে ‘ঘুমায়ো না সহেলি গো আজি এই চাঁদ জাগা রাতে’ গানটা তাঁর কণ্ঠে শুনে বিয়ের আগেই তাঁর স্ত্রী বেলাদেবী ভাবলেন, ‘ইস ওর সঙ্গে যদি বিয়ে হতো।’
বেলাদেবীর বাড়িটা পেরিয়ে দুটো বাড়ি পরে ছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের পৈত্রিক বাড়ি। অনুষ্ঠান সেরে গভীর রাতে বাড়ি ফিরতেন তিনি। এ প্রসঙ্গে বেলাদেবী এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন- ‘’আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় গান গাইতে গাইতে ও ফিরত। আমার ঘুমটা তখন ভেঙে যেত। আমি মাকে বলতাম, ‘মা, ও বাড়ি ফিরছে।’ মায়ের কাছে খুব সহজ ছিলাম। মা বলতেন, তুমি বারান্দায় যাবে তো যাও। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতাম। ওর হাতে মালাটালা থাকলে ও সেটা ছুড়ে দিয়ে যেত।’’
সেই ১৯৫৪ সালেই মানবেন্দ্র বেশ মজা করে অভিনয়ও করেছিলেন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে। তাঁর সুরারোপিত উল্লেখযোগ্য ছবি— ‘চাঁপা ডাঙার বৌ’ (১৯৫৪), ‘মনি ও মানিক’ (১৯৫৪), ‘সাঁঝের প্রদীপ’ (১৯৫৫), ‘উত্তর পুরুষ’ (১৯৬৬), ‘দেবী চৌধুরানী’ (১৯৭৪)।
‘ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে’, ‘তুমি ফিরায়ে দিয়েছ বলে’, ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’- প্রভৃতি গানের কণ্ঠশিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ১৯৯২ সালের জানুয়ারির ১৯ তারিখে মাত্র একষট্টি বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ১৯৩০ সালের আজকের দিনে (১১ আগস্ট) কলকাতার কালিঘাটে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment