জন্মদিনে স্মরণঃ কি শো র কু মা র
বাবলু ভট্টাচার্য : নাম ছিল আভাস কুমার গাঙ্গুলি। সে নামে তাঁকে এখন কেউ চেনে না। তাঁর কণ্ঠ এখনো অনেক বাঙালির মনকে নস্টালজিক করে।
উপমহাদেশের কিংবদন্তী শিল্পী কিশোর কুমার। পুরো নাম কিশোরকুমার গাঙ্গুলী। পিতা কুঞ্জবিহারী গাঙ্গুলী, মা গৌরী দেবী।
‘কিশোর’ একাধারে গায়ক, অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক- আরো অনেক কিছু। কিন্তু তাঁর সব পরিচয়কে ছাপিয়ে গেছে সুললিত, হৃদয় পাগল করা কণ্ঠ আর জীবনবৃত্তের কেন্দ্রই ছিল তাঁর গান।
১৯৪৮ সালে ‘জিদ্দি’ ছবিতে ‘মরণে কি দুয়া’ গানটি দিয়ে ছবির গানে আত্মপ্রকাশ। ‘শাদী’ ছবিতে ‘কিসমত কি বাত’ গানটিতে প্রথম ‘ইওডেলিং’ প্রয়োগ করে আলোড়ন তোলেন। ১৯৬১ সালে নিজের সুরারোপিত ‘ঝুমরু’ ছবির ‘কোই হামদাম না রাহা’ গানটি সুপারহিট হয়। সেই থেকে মৃত্যু অবধি প্রায় ১৮ হাজার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি শচীনদেব বর্মণের সুরে গানের সাম্রাজ্যে প্রবেশ করেন কিশোর। শচীন দেব সুরারোপিত ‘গাইড’ ছবির ‘গাতা রাহে মেরা দিল’ গানটি কিশোরের ক্যারিয়ারে এক নবদিগন্তের সূচনা করে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে পঞ্চাশের দশকের গায়নরীতির, ডাক পড়তে থাকে নতুন লয়ের, নতুন মেজাজের গানে।
আর ডি বর্মণের সুরে ‘অমর প্রেম’ ছবির ‘কুছ তো লোগ ক্যাহেঙ্গে’ কিংবা ‘অভিমান’ ছবিতে রবীন্দ্র সুরভিত্তিক ‘তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র্যায়না’, ‘আরাধনা’ ছবিটি কিশোরের ক্যারিয়ারের জন্য এক মাইলস্টোন। সেই যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে গেলেন, মৃত্যু পর্যন্ত তাঁকে আর কেউ বসাতে পারেনি।
কিশোরের গানের প্রধান সম্পদ ছিল যৌবনদীপ্ত উদাত্ত কণ্ঠ। ‘জিন্দেগি এক সফর হ্যায় সুহানা’ থেকে শুরু করে ‘মেরা জীবন কোরা কাগজ’-এর মতো করুণ গানগুলো সমান দরদ দিয়ে যেভাবে গাইতেন, তা অতুলনীয়। হামিংয়েও ছিলেন অদ্বিতীয়। ‘ইওডেলিং’ তো ছিল বলতে গেলে তাঁর নিজস্ব সম্পদ।
কিশোরের গাওয়া গানে ঠোঁট মিলিয়েই নায়ক ইমেজ গড়েছেন দেব আনন্দ, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন। স্বয়ং রাজেশ খান্না বলেছেন, কিশোর কুমার না হলে তিনি ‘সুপারস্টার’ হতেন না।
বাংলা ছবিতেও প্রচুর গেয়েছেন কিশোর। ‘অমানুষ’, ‘ত্রয়ী’, ‘বৌমা’, ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘রাজকুমারী’, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’, ‘অমর সঙ্গী’, ‘অনুরাগের ছোঁয়া’ ছবির গানগুলো আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সত্যজিৎ রায়ের দু’টি চলচ্চিত্র ‘চারুলতা এবং ‘ঘরে বাইরে’র জন্য তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছিলেন।
কোনো ধ্রুপদী রেওয়াজ ছাড়াই রবীন্দ্রসংগীতে অসাধারণ পটুত্ব দেখিয়েছেন কিশোর কুমার। সমালোচনার ঝড় উঠেছিল তাঁর রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া নিয়ে। ভ্রু কুঁচকেছিল কলকাতার আঁতেল মহল। কিন্তু লং-প্লেগুলো বের হওয়ার পর সবাই স্বীকার করতে বাধ্য হয়, শান্তিনিকেতন-বহির্ভূত এই একজন শিল্পীই তাঁর গানে রবীন্দ্রসংগীতের যথার্থ পুরুষকণ্ঠের সৌজন্য আনতে পেরেছিলেন।
ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ৮৬টি ছবিতে অভিনয় করেন কিশোর কুমার। ১৯৪৭ সালে অরবিন্দ সেনের ‘মুকাদ্দার’ ছবিতে প্রথম অভিনয়। ১৯৫১ সালে ফণী মজুমদারের ‘আন্দোলন’ ছবিতে সর্বপ্রথম নায়কের চরিত্রে রূপদান করেন।
কমেডি চরিত্রের প্রতি কিশোরের একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল। যদিও তিনি পছন্দ করতেন ‘হরর মুভি’। আলফ্রেড হিচকক ছিলেন তাঁর প্রিয় পরিচালক। প্রথম প্রযোজিত ছবি ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ (১৯৫৮)। প্রথম পরিচালিত ছবি ‘দূর গগন কি ছাও মে’ (১৯৬৪) আর তাঁর পরিচালিত শেষ ছবি ‘মমতা কি ছাও মে’ যার কাজ অসমাপ্ত রেখেই তাঁকে চিরবিদায় নিতে হয়।
অক্টোবর ১৩, ১৯৮৭ সালে ৫৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ভারতের এই জনপ্রিয় শিল্পীর মৃত্যু ঘটে।
কিশোর কুমার গাঙ্গুলী ১৯২৯ সালের আজকের দিনে (৪ আগস্ট) মধ্যপ্রদেশের খাণ্ডোয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment