“রটন্তী কালী পূজা (Ratanti Kali Puja)!”
——————————————————
ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ১ ফেব্রুয়ারি ২০২২। কার্তিক মাসে দীপাবলী ও জ্যৈষ্ঠ মাসের ফলহারিণীর মত আরেক জনপ্রিয় কালী পূজা মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথির “রটন্তী কালী” ! মুক্তোকেশী মায়ের মহিমা এদিন প্রচারিত হয়৷ দশ মহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা “কালী” ৷ দেবাসুরের লড়াইয়ে পরাস্ত দেবগণ আদ্যাশক্তির স্তুতি করলে মাতা ভগবতীর দেহকোষ থেকে দেবী কৌশিকী আবির্ভূত হন ৷তখন দেবী কৃষ্ণবর্ণা দেহ ধারন করেন বলে নাম হয় কালী বা কালিকা ৷ কাল শব্দের স্ত্রী লিঙ্গ রূপ “কালী “৷
অমাবস্যা হলো কৌল তিথি ৷ বছরে বারোটি অমাবস্যায় এবং রটন্তীর চর্তুদশী এই তেরোটি ৷ অনেকে চতুর্দশীতে সংকল্প করে অমাবস্যা লাগলেও রটন্তী কালী পূজা করেন ৷দুটো যোগের একসাথে ফল পেতে । “রট” ধাতুর প্রথমার গৌরবে বহুবচনে রটন্তী ৷ রট ধাতুর + অন্ত (ঝচ্) ঈ (ঙীপ্ )৷ রট মানে ছড়িয়ে পড়া বা প্রচার হওয়া ৷ “রটনা” শব্দ থেকে এই শব্দ এসেছে। রটন্তী চতুর্দশীর দিনে দেবীর মহিমা চতুর্দিকে রটে যায়। মুক্তোকেশী মায়ের মহিমাও এই তিথিতে সর্বত্র প্রচারিত হয় ৷ অর্থাৎ মায়ের কৃপাশীষ চতুর্দিকে বর্ষিত হয় – তাই এই তিথিকে রটন্তী অমাবস্যা বলে । যারা দাম্পত্য কলহে জর্জরিত কিংবা স্বামী বা স্ত্রীর সুখ থেকে বঞ্চিত বা প্রেমে বিফল বলা হয় রটন্তী কালীপুজো করলে তাঁরা সফল হন ৷ এই দিনটি দেবী ছিন্নমস্তার আবির্ভাব তিথি। দেবী তাঁর সহচরীদের ক্ষুধা মেটানোর জন্য নিজের মাথা কেটে তিন ধারায় রক্তবারি প্রকট করেছিলেন ৷ ছিন্নমস্তা দেবী দশমহাবিদ্যার একজন। দেবী সতী পূর্বে পিতার গৃহে যেতে গিয়ে (বাবা দক্ষের যজ্ঞের সময়) ভগবান শিবের কাছে তীব্র বাধা পেয়ে দশমহাবিদ্যা রূপ ধরেছিলেন। সব দেবতা যজ্ঞে নিমন্ত্রণ পেলেও জামাই শিবকে দক্ষরাজ ইচ্ছা করে আহ্বান করেন নি ৷ সতী বলেন তিনি মেয়ে বাবার আমন্ত্রণ ছাড়াও যখন তখন বাপের বাড়ী যেতেই পারেন ৷ কিন্তু , মহাদেব বুঝেছিলেন সতী বাবার কাছে গিয়েও অপমানিত হবে ৷ তাই নিষেধ করেছিলেন ৷ মেয়ের মন মানে নি ৷ তখন পতি শিবকে নিজের দশটি রূপ দেখান ৷ শিবকে দশদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেন ৷ কাল মানে সময় ৷ হিন্দু ধর্মে মহাবিদ্যা ধারনার বিকাশ পৃথিবীর ধর্মীয় ইতিহাসে অভূতপূর্ব ৷ যেখানে পরম সত্বা বা ঈশ্বর নারী রূপে কল্পিত ৷ দেবী ভাগবত পুরাণে বিশেষতঃ ঐ গ্রন্থের সপ্তম স্কন্দের শেষ নয়টি অধ্যায়ে “দেবী গীতা” য় শাক্ত ধর্মের এই বিষয়ের ব্যাখ্যা পড়লে চোখ খুলে যায় ৷ মহা (মহৎ) ও বিদ্যা ( প্রকাশ , রূপ , জ্ঞান বা বুদ্ধি) হলো মহাবিদ্যা ৷ এর সঙ্গে সংখ্যাবাচক দশ যোগ হয়ে দশমহাবিদ্যা ৷ একই সত্য দশটি ভিন্ন রূপে প্রকাশিত ৷ দিব্যজননী মা দশটি রূপে দৃষ্ট ও প্রকাশিত ৷ বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির আদি কারন ৷ আবার আরেক অর্থ মৃত্যু ৷ ছিন্নমস্তা সেই মহাবিদ্যাদের একজন। এই দেবী সকামরত মদন ও রতি দেবীর ওপর প্রত্যালীঢ় ভঙ্গিতে দণ্ডায়ামানা। তিনি নিজ মুণ্ড ছিন্ন করেছেন। বাঁ হাতে দেবী নিজেই নিজের মুণ্ড ধারণ করেছেন। ছিন্ন স্কন্ধ (কাঁধ ) দিয়ে তিনটি রক্তধারা দেবীর মুখে ও দেবীর সহচরী ডাকিনী ও যোগিনীর মুখে পতিত হচ্ছে। বলা হয় দেবীর দুই সহচরী দেবীর কাছে আহার প্রার্থনা করলে দেবী এই রূপে এসে সহচরীদের ক্ষুধা নিবৃত্তি করেছেন। ভয়ংকরী দেবীর এই রূপ ব্রহ্মচর্যের প্রতীক রূপে পূজিতা হয়। আসলে ঐরূপে দেখানো হয়েছে চক্রপথে আত্মধ্বংস ও আত্মপুনরুজ্জীবন ৷ আবার রটন্তির দিন মা বগলারও আবির্ভাব তিথি । মা বগলামুখী শত্রু নাশিনী দেবী রূপে পূজিতা হন। যিনি ঈর্ষা , ঘৃণা ও নিষ্ঠুরতার মত মানব চরিত্রের অন্ধকার দিকগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করেন ৷ ত্রেতা যুগে যখন লঙ্কার অশোকবনে রাবণ সীতাকে ধরে রেখেছে ৷ সেই সময় মহীরাবণ রাম -লক্ষ্মণকে পাতালে নিয়ে যায় ৷ উদ্দেশ্য দেবীর কাছে বলিদান ৷ তাই রাম ও লক্ষ্মণকে বলে দেবীর কাছে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে সে কথা মা সীতা জেনে যান ৷ মা সীতাই তো আসলে মহামায়া /কালী / লক্ষ্মী/ জগৎ জননী ৷ তিনি তখন হনুমানের মাধ্যমে দুই ভাইকে শিখিয়ে দেন কিভাবে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে হয় মহীরাবণ যেন দেখিয়ে দেয় ৷ মহীরাবণ শুয়ে পড়লে দেবীর খাঁড়ায় বধ হন ৷ এই কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে বলে নাম হয় “রটন্তী ” ৷ আবার দ্বাপর যুগে মাঘ মাসের চর্তুদশী সংযুক্ত অমাবস্যায় শ্রীরাধা কালীরূপী শ্রীকৃষ্ণকে কদম গাছতলায় ফুল ও ফল দিয়ে পুজো করেছিলেন। আসলে শ্বাশুড়ি জটিলা ও ননদ কুটিলা রাধা কৃষ্ণের সাথে লীলা করতেন বলে স্বামী আয়ান ঘোষকে নিয়ে সেই গোপন সর্ম্পক ধরতে গিয়ে দেখে রাধা এভাবে কালী পুজো করছেন ৷ আসলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এদের অভিসন্ধি বুঝে নিজে কালী রূপ ধারন করেছিলেন ৷ যা কৃষ্ণ-কালী রূপে খ্যাত ৷ এই সময় জটিলা , কুটিলা এবং আয়ান সহ সবার ভুল ভাঙ্গে ৷ শ্রীরাধা যে স্বয়ং আদ্যাশক্তি তা বুঝতে পারেন ৷ এই রটনা থেকে ভক্তরা “রটন্তী কালী ” পুজো করতে থাকেন৷ এর মধ্যে দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ বুঝিয়ে দেন কৃষ্ণ ও কালী অভেদ ৷ মাঘ মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে কালীর দেখা পাওয়ায় ঐদিন বিশেষ ভালে কালী অর্থাৎ রটন্তী কালীপুজোর প্রচলন হয় ৷ শাক্তদের এই বিশেষ দিন শ্রীকৃষ্ণের জীবনের সাথে জুড়ে যাওয়ায় এটি বৈষ্ণবদের কাছেও বিশেষ দিন ৷ আবার চতুর্দশী মহাদেবের প্রিয় তিথি হওয়ায় শৈব মতেও এটি বিশেষ দিন ৷ তাই , দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে এদিন মা ভবতারিণী , রাধাকৃষ্ণ ও শিবের পুজো হয় ৷ এভাবে সনাতন ধর্মের সব মত একাকার হয়ে গেছে রটন্তী তিথিতে ৷
“ওঁ ক্রীং ক্রীং হৃং হিং হিং দক্ষিণে কালীকে ক্রীং ক্রীং ক্রীং হৃং হৃং হ্রীং হ্রীং স্বহা ৷”ওঁ ক্রীং কাল্ল্যৈ নমঃ “৷
Be First to Comment