=========(পর্ব-০৩৫)=============== =====”যাঁদের ঋণ শোধ করতে পারবো না”====
জাদুশিল্পী পি সি সরকার জুনিয়র : ২৮,জানুয়ারি, ২০২১। আমি যখন প্র-থ-ম 'মহাজাতি সদন' রঙ্গমঞ্চ বুক করতে মনস্থ করি, তখন মনোরঞ্জনের আসরে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে উপদেশ নেবার মতো বিচক্ষণ মানুষের খুব অভাব ছিলো। এমনিতেই বাঙালিরা সব ব্যাপারের সব কিছুই জানেন ; ফ্রী-তে উপদেশ দেবার লোক কিলবিল করছে । সেজন্য, তার মধ্য থেকে একজন কাউকে বেছে নেওয়া সত্যিই এক প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। অ্যারিস্টটল নাকি বলেছিলেন, "যে ব্যক্তি অন্যের উপদেশ নেন না, তিনি নির্বোধ! কিন্তু তার চেয়েও বেশি নির্বোধ হচ্ছেন তিনি, যিনি সব্বার উপদেশই নেন।" কথাটার সারমর্ম বাঙালি এখনোও বোঝেনি। আমি খাঁটি বাঙালি। 'র' বাঙাল। আমি কিন্তু হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। বাবা তখন সবে মারা গেছেন। মাথার ওপর কে-উ নেই। অসহায় বোধ করছি। তখন ওই 'সব্বার উপদেশের ঘ্যাঁট' আমাকে আরও অসহায় করে তুলেছিলো। তাদের উপদেশটা নাকি নিতেই হবে। নইলে ...বিচ্ছেদ। "মরোগে যাও।... পরে এসো না ।" বাবা তাঁর ইন্দ্রজালের আসর বসাতেন 'নিউ এম্পায়ার থিয়েটার' হলে। কিন্তু শেষের বেশ কয়েক বছর তিনি সেখানে শো করতে পারেন নি। কারণ ওটার মালিক, তাদের ওই হলটাকে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের এক সিনেমা কোম্পানির কাছে লিজ দিয়ে দিলেন। তাঁরা শুধু নিজেদের সিনেমা চালাতে চান, কোনো স্টেজ প্রোডাকশন নয়। সুতরাং মঞ্চ অংশ বন্ধ্। বাবা "নিজের শহরে শো করতে পারবো না!!", বলে খুব আক্ষেপ করতেন। মহাজাতি সদন তখন থাক
তো দিনের পরদিন ফাঁকা। পরিবেশ দূষণের কারনে ‘ টিকিট বিক্রি করে শো’ হতোই না। তাছাড়া মঞ্চের ওপর থেকে পর্দা ঝোলাবার জন্য কোনোও উপায়ই ছিলো না। সেজন্য বাবা কখনোও মহাজাতি সদনে শো করেন নি। তখন তৈরি হচ্ছিলো, রবীন্দ্র সদন। কিন্তু সেটা নাকি কাউকে দু-দিনের বেশি দেওয়া হবে না। তাতে অন্য কারুর অসুবিধা হয়নি। কারণ তাঁদের শো, টিকিট বিক্রী করে একদিনের বেশি চলেনা।
কিন্তু আমাদের চাহিদা জনগণের জন্য মাসের পর মাস। জনগণের দাবী, জনগণের জন্য তৈরি রঙ্গমঞ্চ! কিন্তু গণতন্ত্রের জয় হয়নি। হয়না। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। এখনও তাই। শিল্পীরা ‘অনুদান’ চেটে, হুক্কা-হুয়া করে বেঁচে আছেন। সেই শিল্পীরা আবার সঠিক শিল্পী কিনা তার পরীক্ষায় বসতে হবে হাইতোলাবাজ পরীক্ষকদের কাছে। তাঁরা ব্রীজ পরীক্ষা করেন, ভাগাড়ের মাংস পরীক্ষা করেন আবার শিল্পটা ঠিক তাদের মনের মতো ‘ষিপলো’ হলো কিনা তারও বিচার করেন । সুতরাং কলকারখানার ‘শিল্প’ আর আর্টের শিল্পে একই তালে ‘উন্নয়ন’ ঘটাচ্ছেন। বক্তব্যে ভুল থাকলে, “সরি, আই টেক মাই ওয়ার্ডস্ ব্যাক ।” শুনেছি এই কথাটা বলে বাক্যবাণ ফিরিয়ে আনা যায়। তাই বলে রাখলাম। বাবা শেষ বয়সে, অসুস্থ অবস্থায়, যে কোলকাতায় ‘হল’ না পেয়ে, জাপানে যান। এবং মারা যান। তাহলে, আমার বাবার মৃত্যুর জন্য কি ওরা দায়ী? আমার তো তাই মনে হয়। তাই যদি হয়ে থাকে তো আমার মা’র চোখের জলের অভিশাপটা দেখি ওরা কাটায় কীভাবে। সঙ্গে আমার অভিশাপটাও রইলো।
জাপান থেকে কলকাতায় এসে আমি পড়লাম মহাফ্যাসাদে। “দ্য শো মাস্ট গো অন !” কিন্তু কোথায় শো করবো ?
অমৃতবাজার পত্রিকার মনোরঞ্জনের পৃষ্ঠার সম্পাদক নির্মল কুমার ঘোষ মহাশয়ের কাছে গিয়ে পরামর্শ চাইলাম, বললাম মহাজাতি সদনে করলে কি জনগণখুশী হবেন? উনি আঁৎকে ওঠেন, বলেন তার চেয়ে ময়দানে প্যান্ডেল বানিয়ে করা ভালো। ওখানে বিয়ে বাড়ি, লটারি এবং চটুল নাচা-গানা, চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে গানের সঙ্গে বেলেল্লাপনা, এসব চলে। সুনাম নেই।
“কিন্তু আমার তো, আর কোথাও উপায় নেই।”
– তাহলে কপাল ঠুকে দ্যাখো। গেলাম মহাজাতি সদনে। পেছনের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায়। সেক্রেটারি শ্রী অনিল রায় চৌধুরী,WBCS. আমি, আমার স্ত্রী, জয়শ্রীকে সঙ্গে নিয়ে গেছি। নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললাম, হল বুক করতে এসেছি। লাগাতার তিন-চার মাস।

ভেবে ছিলাম উনি চমক খাবেন, খুশী হবেন! কিন্তু কোথায় কি! নিরুত্তাপ ভাবে বললেন, ” হল খালি নেই।”
–“শুনে ছিলাম, দিনের পর দিন খালি পড়ে আছে…!!’
–“ভুল শুনেছেন।”
-“আমি পুরো তিনমাসের ভাড়া এক্ষুনি অগ্রিম দিতে প্রস্তুত আছি। যেদিন থেকে খালি আছে, সেদিন থেকে তিন চার মাস।”
–“বললাম তো, খালি নেই।”
আর কি বলা যায়। জয়শ্রীকে বললাম, “কোলকাতায় আর এ-জন্মে হলো না। চলো দেখি সিঙ্গাপুরে গিয়ে করি। অথবা আবার মুম্বাই বা দুবাইতে।”
নমস্কার জানিয়ে বেড়িয়ে এলাম।
সিঁড়ি দিয়ে নামছি।কয়েক ধাপ নামতেই দেখি একজন সুদর্শন, ব্যক্তিত্বময় স্বাস্থ্যবান ভদ্রলোক উঠছেন। ওই অফিসেই যাবেন। আমাকে দেখে থমকে বললেন,”..আপনি কি মিস্টার পি সি সরকার জুনিয়র ? আর ম্যাডাম জয়শ্রী !!… আপনারা এখানে ??!!”
বললাম ” এখানে ইন্দ্রজালের আসর বসাবো ঠিক করে ছিলাম..ডেট নেই, হলো না ?”
ভদ্রলোক অবাক !!! আঁৎকে উঠলেন, ” ডেট নেই মানে ?? সে কি!!! কে বলেছে ? “
—“স্বয়ং সেক্রেটারি সাহেব !”
—“অ্যাঁ !! ..আমার নাম প্রশান্ত সরখেল। আমি মহাজাতি সদনের ইলেকট্রিক ডিপার্টমেণ্টের অফিসার…আপনারা দয়া করে আমার সঙ্গে একটু আসুন তো। প্লীজ..”
যেতেই হলো ওই অফিসের ভেতরে , নতুন করে, আর একবার। তবে এবার অন্য ভাবে , প্রশান্ত বাবুর সঙ্গে, গট্ গট্ করে।
নাটকীয় ব্যাপার ! দরজা ঠেলে খুলে সেক্রেটারি বাবুকে চমকে দিয়ে বলেন,–“আপনি নাকি এনাদের বলেছেন ‘হল’ খালি নেই ?? তাহলে তো আমাদের স্টাফেদের কোনো দুঃখও নেই। দিন, আমাদের অস্থায়ী কর্মচারী দের মাইনে দিন। ‘হল’ কেউ নেয় না, টাকা নেই, লস্-এ রান করছি..এসব শুনিয়ে আমাদের মাইনে আটকে রেখেছেন। এই ভদ্রলোক তিনমাস একটানা হল নিতে চাইছেন…আর আপনি বলেছেন হল খালি নেই। মিথ্যে কথা বলেছেন।..”
–“মানে আমি ভেবেছিলাম, ব্যাপারটা সত্যি নয়। তিনটে মাস, একটানা, রোজ, কেউ নেয় ?
–“আমি নিই। পৃথিবীতে এক মাত্র আমি। আপনি চেকে নেবেন নাকি ক্যাশে ?”, আমি বললাম।
টাকা জমা দিলো জয়শ্রী। বললো, “টিকিট বিক্রি হবে কোন কাউণ্টার থেকে, কিছুতো নেই। যদি অনুমতি দেন তো আমরা প্লাই-উড দিয়ে বানিয়ে নেবো। নিজেদের খরচায়।”
প্রশান্ত বাবুর আবার মুখ খুললেন,” কাউণ্টার না থাকলে মা লক্ষ্মী আসবেন কীভাবে? আপনি তৈরি করুন, আমরা এসব জানতাম না। মহাজাতি তে মা লক্ষ্মীর আগমন ঘটুক। তবে কাউণ্টারটা আমাদের দান করে যাবেন। এটা আমাদের অনুরোধ”
আমি এবং জয়শ্রী কথা দিলাম।
তারপর তো শুরু হলো ইতিহাস। সব কথা কি
এটুকু জায়গায় লেখা যায় ? সর্ব সাফল্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন আপনারা, কলকাতার মানুষেরা করে দেখিয়েছেন। সাড়ে সাত মাস একটানা হাউজফুল।তিন মাস আগের থেকে অগ্রিম হাউজ ফুল। বিশ্ব রেকর্ড।
কলকাতা আমার প্রাণ। আপনারা আমার হৃদ্স্পন্দন। কেউ কলকাতাকে নিন্দে করলে, বা আমাদের আর্ট এবং কালচারকে খাটো করলে আমার মাথায় খুন চেপে যায়। তখন নিজেকে স্বান্তনা দিয়ে বলি, এখানে কুঁড়ে, স্বপ্ন বিহীন লোক যেমন আছে, সেরকম ইতিহাসকে মোচড় দিয়ে বিশ্ব-রেকর্ড তৈরি করতে শ্রী প্রশান্ত সরখেলের মতো মানুষও আছেন। তাঁরা আছেন বলেই বাঙালি আজও আছে, থাকবে।
উনি রিটায়ার করেছেন। জয়নগর-মজিলপুরের জনপ্রিয়তম মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভালো আছেন। সুস্থ আছেন। উনি দেবদূতের মতো হাজির হয়ে ছিলেন বলেই আপনারা আমায় চিনছেন, জানছেন। এই ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না।
প্রশান্তদা, আপনি আমার প্রণাম নেবেন। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন। -Magician P.C.Sorcar Junior,
(Dr. Prodip Chandra Sorcar, M.Sc., Ph.D.) পুনঃ-। শুনলাম নতুন ম্যানেজমেণ্ট এসে ওই টিকিট কাউন্টার ভেঙ্গে ফেলে দিয়েছে। সীটে কমিয়েছে। পেছনের মাল পত্র, সেটিং রাখার যথেষ্ট জায়গা নেই। সেখানে ভি.আই.পিদের জন্য আলাদা বিশ্রাম কক্ষ , টয়লেট তৈরি হয়েছে, আড়ালে। ওই হলে আর বড় মাপের সেটিং, যন্ত্রপাতি নিয়ে বড় শো হওয়া আর সম্ভব নয়। হবে না। কোন দিনও না । অবশ্য তাতে কার কি। একে একে সবাই তো গেছে। ম্যাজিকও না হয় গেলো।
Be First to Comment