বিপ্লব মজুমদার –
(আন্তর্জাতিক কবি ও সাহিত্যিক)
লেখা নিয়ে কোনও একসময় লিখেছিলাম,
“মুহূর্তে মুহূর্ত জুড়ে
পুজো সারাদিন,
তবুও হয় না সারা
আজন্মের ঋণ।”
(লেখা/ কাব্যগ্রন্থ–নির্জিত নির্জন কাঁচঘর,২০১১)
আমরা যারা শব্দের আশ্রয়ে জীবন নির্বাহে ব্রতী , বছরভরই তাদের কিছু না কিছু লিখে যেতে হয়। কখনো পত্রপত্রিকার সম্পাদক বন্ধুদের তাগাদায়, কখনো বা আপন মনের তাগিদে। এছাড়া প্রকাশক বন্ধুদের নির্ধারিত বাৎসরিক কার্যক্রম তো থাকে ই।
তবে এ বছর পরিবেশ-পরিস্থিতি এতটাই ব্যতিক্রমী যে পুজোর আনন্দ অপেক্ষা আতঙ্কের অভিঘাতেই সকলে বিমর্ষ। আজ ২৫ শে জুলাই, ২০২০তে এ লেখা যখন লিখছি তখন সমগ্র বিশ্বে করোনার করাল গ্রাসে দেড় কোটি মানুষ, মৃত্যু হয়েছে প্রায় ছ লাখ বিশ হাজারের উপর। ইউনাইটেড স্টেটস, ব্রাজিলের পরেই ভারতবর্ষের স্থান। মনে রাখতে হবে, এই পরিসংখ্যান কিন্তু সরকারি। মাত্র ছয় মাসে সাড়ে ছয় লাখ মানুষের মৃত্যু— শিউরে ওঠার মতন ঘটনা। এখানেই এ মারণ- যজ্ঞ শেষ নয়, এ ক্রমবর্ধমান। আমরা কেউই জানি না এ মৃত্যু-পথ- যাত্রার শেষ ঠিক কোথায়। এমন এক ভয়াবহ মারণ রোগ যার সামনে ফ্রান্স, ইতালি, ইউকে, আমেরিকা ইত্যাদি সহ বিশ্বের সকল উন্নত দেশগুলি নাজেহাল এবং অসহায়। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা দিনরাত গবেষণাগারে লড়ে যাচ্ছেন এর প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারে। গোটা পৃথিবীর মানুষ প্রার্থনা জানাচ্ছেন, যত শীঘ্র সম্ভব তারা যেন সফল হতে পারেন। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, প্রশাসন আপ্রাণ চেষ্টা করছেন মানুষের প্রাণ রক্ষা করতে। সমগ্র মানব সভ্যতা আজ এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্য ভাইরাসের ভয়ে ত্রস্ত। মানুষ আজ বাস্তবিকই বড় কঠিন সময়ের মুখোমুখি। মুখোশের আড়ালে চলে গেছে মুখেরা। সকলেই চাইছেন দূরে দূরে থাকতে, অন্তত যতটা দূরে গেলে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। পুজো, খেলা, মেলা, মিটিং-মিছিল সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি উপলক্ষে বহু মানুষের একত্র হওয়া এখন মোটেও নিরাপদ নয়। আগামী দিনে এর প্রভাব কতটা সুদুরপ্রসারী তা ভাবার বিষয়।লকডাউন, কনটেইনমেন্ট জোন, বাফার জোন, মাস্ক, স্যানিটাইজার, সেফ ডিসটেন্স, কোয়ারেন্টাইন, কোভিড পজিটিভ, গারগল, স্টিম ইনহেলেশন, অক্সিমিটার, ইমিউনিটি বুস্টার, টেস্ট কিট, প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট, ভিটামন সি জিঙ্ক ট্যাবলেট, হাই পিএইচ ফুড—- ইত্যাদি অদ্ভুত কিছু শব্দেরা আমাদের চারদিক থেকে আক্রমণ করছে। সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে একটিমাত্র বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে ভাবনারা—- মূল্যবান, জীবন বড় মূল্যবান। একে রক্ষা করতেই হবে। আজ দূষণমুক্ত নির্মল পরিবেশ, অথচ পার্কে শিশুর দেখা নেই। বন্ধুরা মনে এবং ফোনে থাকলেও পাশাপাশি বসে জমাটি আড্ডা দেওয়ার সুযোগ নেই। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী থাকলেও জমায়েত নেই। হোটেল-রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া নেই। বেড়াতে যাওয়া নেই। নতুন জামা-কাপড় কেনা কাটা নেই, খেলার মাঠের উন্মাদনা নেই। অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখাবার উপায় নেই। করোনা হলে বাঁচার আশা নেই। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই করোনা কাল কেটে গেলে আসছে ভয়ানক অর্থনৈতিক মন্দা। ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে ছাঁটাই পর্ব। আগামী দিনে যা মারাত্মক আকার নেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাল্লা দিয়ে বাড়বে হতাশা, উদ্বেগ, আত্মহনন, এবং অতি অবশ্যই অপরাধ প্রবণতা। এত প্রতিকূলতা, এত প্রতিবন্ধকতা, এত দূর্যোগ— তবু তার মধ্যেই কিছু উৎসর্গীকৃত প্রাণ এগিয়ে আসছেন পত্রপত্রিকা প্রকাশে, মা দুর্গার আবাহনে এবং রঙিন স্বপ্নের দিশা নিয়ে। এ বড় আশার কথা, আনন্দের কথা। আসলে নদী এবং সময়ের মতন জীবনও সতত প্রবহমান। শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে তা তার নিজের পথ খুঁজে নেয়। জীবনের নিয়মই তাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “দুর্দশার হাত হইতে উদ্ধারের কোনো পথই নাই, এমন কথা মনে করা মানুষের ধর্ম নয়। মানুষের ধর্ম জয় করিবার ধর্ম, হার মানিবার ধর্ম নয়”। করোনার আহবকাল অতিক্রম করে করে মানব সভ্যতা জয়যুক্ত হবেই —এ বিশ্বাস নিয়ে আজ কলম রাখছি। সকলকে আগাম শারদ শুভেচ্ছা ।
Be First to Comment