স্মরণঃ স ম রে শ ব সু
বাবলু ভট্টাচার্য : রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম একজন কথাসাহিত্যিক হলেন সমরেশ বসু। প্রথাগত বিদ্যা বা দারিদ্রতা যে মহান প্রতিভাকে কোনদিন আটকে রাখতে পারেনা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ সমরেশ বসু।
অবিভক্ত বাংলাদেশের রাজনগরে এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯২৪ সালে তার জন্ম। পিতা মোহিনীমোহন বসু তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘সুরথনাথ’ কিন্তু পরবর্তীতে তা সমরেশ বসুতে পরিণত হয়।
ছোটবেলা থেকে বন্ধনহীন, চঞ্চল সমরেশের পড়াশুনার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিলনা। লেখাপড়া শিকেয় তুলে বাইরের প্রকৃতির টানে তিনি ঢাকার বিস্তীর্ণ শহরতলীর আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতেন সবসময়।
যখন তার বয়স মাত্র বারো বছর তখন তিনি নয় বছরের এক বালিকার প্রেমে পড়েন। ছেলের এই অকালপক্কতার কথা জানতে পারা মাত্রই পিতা মোহিনীমোহন তাকে বড়দাদা মন্মথনাথের কাছে নৈহাটিতে পাঠিয়ে দেন। দাদা সেখানে তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেও সমরেশের আচরণের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় না এবং তিনি পরিক্ষায় অকৃতকার্য হন। ফলস্বরূপ দাদা মন্মথনাথ তাকে আবার ঢাকায় নিজ বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। সমরেশের এইরূপ আচরণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পিতা মোহিনীমোহন তাঁকে ‘ঢাকেশ্বরী কটন মিলে’ কাজে লাগিয়ে দেন।
কিন্তু ছোটবেলা থেকেই যে নিজেকে সকল বন্ধন থেকে মুক্ত করে রেখেছে তার পক্ষে এই মিলের বাঁধাধরা কাজ কীভাবে করা সম্ভব? তাই সেখানেও তার মন বসল না আবার ফিরে গেলেন দাদার কাছে নৈহাটিতে। এখানে আসার কিছুদিন পরেই সমরেশ আক্রান্ত হলেন ম্যালেরিয়া ও জন্ডিস রোগে।
দাদা ছিলেন তার চিকিৎসার ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন। এইরূপ অবস্থায় বন্ধু দেবশঙ্করের স্বামী বিচ্ছিন্না দিদি গৌরির সেবায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং এই সূত্র ধরেই একে অপরের প্রেমে পড়ে যান।
গৌরিদেবী ছিলেন সমরেশের থেকে চার বছরের বড় ও ব্রাহ্মণ কন্যা। তা সত্ত্বেও সমাজের সমস্ত বাধাকে উপেক্ষা করে তিনি গৌরিদেবীকে নিয়ে চলে আসেন আটপুরের বস্তিতে।
নানান অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে তাদের দাম্পত্যজীবন শুরু হয়। সমরেশ বসু তখন পুরোপুরি বেকার তাই পেটের দুটো ভাতের জন্য তাকে অনেক নীচু কাজও করতে হয়েছে। কখনও তিনি সবজির বোঝা মাথায় নিয়ে সবজি বিক্রি করেছেন আবার কখনও কখনও সাহেব বাবুদের কোয়ার্টারে কোয়ার্টারে ডিম ফেরি করে বেড়িয়েছেন। তিনি নিজেই বলেছেন — “সপ্তাহে তিনচার দিন আমাদের দু’জনের খাওয়া জুটত”।
১৯৪২ সালে তার পরিচয় ঘটে কমিউনিস্ট নেতা সত্যপ্রসন্ন দাশগুপ্তের সঙ্গে। তিনি সমরেশকে চটকল এলাকায় কিছু কাজের দায়িত্ব দেন। সত্যপ্রসন্নের সংস্পর্শে আসার পরই তিনি কমিউনিস্ট ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হতে শুরু করেন।
সত্যবাবু সমরেশকে নানাভাবে সাহায্য করতেন তার জন্যই ‘ইন্সপেক্টরেট অফ স্মল আর্মস’-এর ড্রয়িং অফিসে সমরেশ বসু চাকরি পান। ফলে অভাব যেমন কিছুটা কমে তেমনি রাজনীতির আঁচ গায়ে এসে লাগে। এরপর তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন এবং সাংস্কৃতিক ঘষা- মাজা ও অনুশীলনের দ্বারা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে শুরু করেন।
১৯৪৪ সালে তিনি ও গৌরীদেবী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির ঋণের কথা স্বীকার করে পরবর্তীতে সমরেশ বসু নিজেই বলেন– “কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসার পরেই আমার চারপাশের জগত ও মানুষ সম্পর্কে দৃষ্টি সজাগ হয়। আমার অভিজ্ঞাতর প্রসার ঘটে।
১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলে তিনি গ্রেফতার হন। পার্টিকে তিনি ভালোবাসতেন আর এই ভালোবাসাকে কোন অবস্থায় ক্ষুণ্ণ করতে না চাওয়ায় তিনি কারারুদ্ধ হন এবং ১৯৫১ তে তার চাকরিও চলে যায়। এরপর নিজের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে সাহিত্য রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। কারাগারে বসেই লিখতে শুরু করেন ‘উত্তরঙ্গ’। শুরু হয় এই মহান শিল্পীর মহৎ যাত্রা।
সৃষ্টিকর্ম:
১৯৪৬ সালে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় তার প্রথম ছোটগল্প ‘আদাব’ প্রকাশীত হয়। এরপর ১৯৫০-১৯৫৫ এই দীর্ঘ পাঁচ বছর তার সাহিত্য জীবনের যথার্থ সংগ্রামের পর্ব। এইসময় তিনি একে একে ‘ উত্তরঙ্গ’, ‘বি. টি. রোডের ধারে’, ‘শ্রীমতি কাফে’ প্রভৃতি। তার রচিত গ্রন্থগুলি নীচে দেওয়া হলঃ
উপন্যাস :
উত্তরঙ্গ, নয়নপুরের মাটি, বি.টি.রোডের ধারে’, ‘শ্রীমতি কাফে, গঙ্গা, ত্রিধারা, পুতুলের খেলা, বাঘিনী, দুরন্ত চড়াই, ছিন্নবাধা, ফেরাই, বিবর, স্বীকারোক্তি, প্রজাপতি, আত্মজ, অপরিচিত, পদক্ষেপ, অচিনপুর, বিষের স্বাদ, ওদের বলতে দাও, অশ্লীল, ত্রিধারা, পথিক, প্রাচীর, সংকট, মহাকালের রথের ঘোড়া, শেষ অধ্যায়, মরীচিকা, তিনপুরুষ, উদ্ধার, প্রকৃতি প্রভৃতি।
গল্পগ্রন্থ:
মরশুমের একদিন, অকাল বৃষ্টি, ষষ্ট ঋতু, বনলতা, পাপপুণ্য, শ্রেষ্ঠ গল্প, হ্রেষাধ্বনি, কামনাবাসনা, নাচঘর, কুন্তীসংবাদ, বিবরমুক্ত, ছায়াচারিনী, বাছাই গল্প, ছোট ছোট ঢেউ, বিবেকবান ভীরু প্রভৃতি।
কিশোর সাহিত্য সমূহ:
মোক্তার দাদুর কেতু বধ, বদ্ধ ঘরের আওয়াজ, গোগল চিক্কুস নাগাল্যান্ডে, সেই গাড়ির খোঁজে, ভুল বাড়িতে ঢুকে, জঙ্গল মহলে গোগল, বিদেশী গাড়ির বিপদ।
সমরেশ বসু ১৯৮৮ সালের আজকের দিনে (১২ মার্চ) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment