শু ভ জ ন্ম দি ন ক বী র সু ম ন
“হাত থেকে হাতে বুক থেকে বুকে করে দেব গোপনে পাচার/ ভালোবাসার নিষিদ্ধ ইস্তেহার/ ভালোবাসার নিষিদ্ধ ইস্তেহার…”
[ কবীর সুমন ]
বাবলু ভট্টাচার্য : রাষ্ট্রীয় এবং ধর্মীও সংকীর্ণতার সীমানা পেরিয়ে যে মানুষটি বাংলা ভাষায় অসংখ্য গান রচনা করে, সুর ও কণ্ঠ দিয়ে গিটারে তুলেছেন, যার গিটার বারবার প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে সমকালীন রাজনীতি, নিপীড়ন ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে, ‘বিদ্রোহী বিচ্ছু’ ছোট্ট ছেলেমেয়েদের ভালবেসে যিনি তাঁর ‘নিষিদ্ধ ইস্তেহার’ ছড়িয়ে দিয়েছেন বহুবার বহু আন্দোলনে, সিঙ্গুর থেকে শাহবাগ… যার গানে বারবার গর্জে উঠেছে গন জাগরণ, তিনি কবীর সুমন।
তিনি হচ্ছেন সেই বাঙালি যাঁর মধ্যে মিশে আছে ধ্রুপদী সেকাল, মৌলিক একাল। কবি, সুরকার, গায়ক, গিটারিস্ট, সাংবাদিক, অভিনেতা এবং সর্বোপরি একজন বিদগ্ধ বাঙ্গালি– কত বিচিত্র কবির সুমনের দস্যিপনা, কী বিপুল তাঁর বিচরণক্ষেত্র, কী লজ্জ্বাকর আমাদের মধ্যমেধার আটপৌরেমি তাঁর বৈচিত্রের তুলনায়!
সুমন নাইলন স্ট্রিং এর একটা অ্যাকুইস্টিক গিটার হাতে, মানুষের সামনে জোরালোভাবেই জানান দিলেন নিজেকে। সুরপ্রধান বাংলা গানকে ভেঙে লিরিক্যাল মেজাজ দিলেন, নিজের লেখনী দিয়ে। এবার আর নদী, নারী, ফুল, ভ্রমর, মেঘ, বৃষ্টিতে বাংলা গান আটকে থাকল না, বরং নেমে এল প্রতিদিনের জীবন বাস্তবতায়।
গানের কথা আশ্রয় করল মানুষের অসংখ্য সমস্যা, মানবিকতা, জীবনবোধ এবং নাগরিকতার বিভিন্ন অনুষঙ্গে। সংগীতায়োজন পেল এক ভিন্ন মাত্রা।
স্ট্রিং, স্যাক্সোফোন, পারকিউশান আর ঢোল, তবলা, বাঁশির জায়গায় এল- অ্যাকুইস্টিক গিটার, হারমোনিকা, পিয়ানো এবং কিছুক্ষেত্রে অ্যাকুইস্টিক ড্রামস। গিটারের বাদন- শৈলীতে ধরা পড়ল পশ্চিমা রীতি। মেলো রক, জ্যাজ, ব্লুজের প্রভাব বোঝা গেল বেশ।
সুমন নব্বই দশকে আত্নপ্রকাশ করলেও, তাঁর সঙ্গীত ভাবনায় দেখা মিলল সত্তর দশকের বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, পিংক ফ্লয়েড, বব মার্লে, জন লেনন এবং বিটলসের।
পরে সুমনের হাত ধরে, পাশ্চাত্যের ভঙ্গিতে উঠে এল আমাদের জীবনবোধের গল্প। অনেকে অবশ্য এই ধারাকে ‘জীবনমুখী বাংলা গান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, নচিকেতা ও অঞ্জন যেখানে অন্য দুই দিকপাল। সুমন আমাদের বব ডিলানের মতো করে শোনালেন-হাল না ছাড়ার কথা।
ছেলেবেলা ও কৈশোরকে ফেলে আসার মনোব্যাথা উচ্চারিত হল- ‘গানওয়ালা’ গানে। ১৯৯২ সালের প্রথম অ্যালবামের টাইটেল ট্র্যাকে শোনা গেল-এক ভিন্ন প্রেমের বয়ান।
শুধু প্রেমের ক্ষেত্রেই নয়, সুমন ব্যতিক্রমী হয়ে উঠলেন মানবিকতায়ও। পেটকাঠি চাঁদিয়াল তার অন্যতম নিদর্শন। সাম্প্রদায়িকতাকে তুচ্ছ করলেন বেশ কিছু গানে। প্রতিবাদ উঠে এল ‘নিষিদ্ধ ইস্তেহারে‘। সেইসাথে জাতিস্মরের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করলেন- এক ভিন্ন উচ্চতার মর্মবাণী। নগরজীবনের কংক্রীটে যে দুঃখবোধ ও যন্ত্রণা সতত বয়ে চলে, সুমন তারই বয়ান তুলে ধরলেন পরিমিতভাবে।
তাঁর গানের মতো করেই, তিনি যেন এক ‘নাগরিক কবিয়াল’। ‘ইচ্ছে হল’, ‘বসে আঁকো’, ‘পাগলা সানাই’, ‘যাব অচেনায়’, ‘গানওয়ালা’- প্রভৃতি সব অ্যালবামেই তিনি নগরজীবনের বিশ্বস্ত কবিয়াল।
কবীর সুমন ১৯৫০ সালের আজকের দিনে (১৬ মার্চ) ওড়িষ্যার কটকে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment