———জন্মদিনে স্মরণঃ নবারুণ ভট্টাচার্য———
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, ‘যে পিতা তার সন্তানের লাশকে শনাক্ত করতে ভয় পায়, আমি তাকে ঘৃণা করি’— বলার মধ্য দিয়ে কবি আসলে আমাদের সামনে খুলে দিয়েছিলেন ঘৃণার চেয়েও অবর্ণনীয় দুঃসহ একসময়ের দরজা— যে সময় এত অবরুদ্ধ, এত দুঃশাসনীয় যে পিতা পর্যন্ত ভীত হয়ে পড়েন তাঁর সন্তানকে শনাক্ত করতে। নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা সে কবিতা আমাদের বাংলাদেশে হয়ে উঠেছিল সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে পঠিত অন্যতম প্রতিবাদী কবিতা। সেটা আশির দশক। আমাদের তখন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের দশক। কবিতা পড়ার দশক। কবিতা শোনার দশক। তখন তিনি, অর্থাৎ নবারুণ ভট্টাচার্য, কী ভীষণ আবেগ ও প্রতিজ্ঞার জন্ম দিয়েছিলেন ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’— লেখার মধ্য দিয়ে। নবারুণ আমাদের মনে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন তাঁর সশব্দ পঙ্ক্তিমালার মধ্য দিয়ে। আপাতদৃষ্টিতে যেন আন্দোলনের জনস্রোতে উচ্চারণের জন্যই লেখা তাঁর কবিতা, কিন্তু তার পরও তাতে রয়েছে স্তব্ধতার মধ্যে ঠোঁট নড়ে ওঠার আবেগ, বেদনা ও নির্লিপ্তি।
বিজন ভট্টাচার্য ও মহাশ্বেতা দেবীর একমাত্র সন্তান নবারুণ ভট্টাচার্য। পড়াশোনা করেছেন কলকতার বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুল এবং আশুতোষ কলেজে প্রথমে ভূতত্ত্ব নিয়ে। পরে সিটি কলেজে ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে। ১৯৭৩ সালে একটি বিদেশি সংস্থায় যোগদান করে ১৯৯১ পর্যন্ত সেখানে চাকরি করেন। কিছুদিন বিষ্ণু দে-র ‘সাহিত্যপত্র’ সম্পাদনা করেন এবং ২০০৩ থেকে চালাচ্ছেন ‘ভাষাবন্ধন’ পত্রিকাটি। এর আগে দীর্ঘদিন ‘নবান্ন’ নাট্যগোষ্ঠী পরিচালনা করেছেন। কথাসাহিত্যে নবারুণ আলোচনার পাদপ্রদীপে চলে আসেন ১৯৯৩ সালের প্রথমদিকে ‘হারবার্ট’ উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের পর। ১৯৯৬ সালের দিকে নবারুণের উপন্যাস ‘হারবার্ট’ সম্পর্কে কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর এক লেখায় মন্তব্য করেছিলেন, গত পাঁচ বছরের মধ্যে এটিই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। অন্যদিকে দেবেশ রায় লিখেছিলেন, এই একটা উপন্যাসেই প্রমাণ হয়ে গেছে যে নবারুণ একজন জাত-ঔপন্যাসিক।
নবারুণের লেখায় বারবার ফিরে এসেছে তারুণ্যের ঝুঁকি নেওয়ার বিষয়টি— ঠিক কি বেঠিক, সেটি তো পরের ব্যাপার, কিন্তু তারুণ্যে এই যে একটি ব্যাপার আছে, ঝুঁকি নেওয়ার ও আবেগমথিত হওয়ার, স্পর্ধিত হওয়ার ও ধ্বংস হওয়ার জন্য এগিয়ে যাওয়ার— এসব বিষয় তাঁকে বারবার আকৃষ্ট করেছে। লেখক হিসেবে তিনি আসলে রেসপন্স করেছেন সত্তর দশকের, তাঁর চোখের সামনে দেখা নকশাল আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের। তাঁর সেই রেসপন্স আবার প্রভাবিত করেছে আশি ও নব্বইয়ের দশকের পাঠক ও সংস্কৃতিকর্মীদের।
প্রথম উপন্যাস ‘হারবার্ট’ এর জন্য নবারুণ নরসিংহ দাস (৯৪), বঙ্কিম (৯৬) ও সাহিত্য আকাদেমি (৯৭) পুরস্কার লাভ করেছেন। এই উপন্যাসকে ভিত্তি করে পরে নাটক ও সিনেমাও তৈরি হয়েছে।
নবারুণ ভট্টাচার্যের অন্যান্য রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ‘কাঙাল মালসাট’, ‘লুব্ধক’, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’, ‘হালালঝান্ডা ও অন্যান্য’, ‘মহাজনের আয়না’, ‘ফ্যাতাড়ু’, ‘রাতের সার্কাস’ এবং ‘আনাড়ির নারীজ্ঞান’।
জুলাই ৩১, ২০১৪ সালে আন্ত্রিক ক্যান্সারের কারণে তিনি কলকাতায় ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়, ৬৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
নবারুণ ভট্টাচার্য ১৯৪৮ সালের আজকের দিনে (২৩ জুন) মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment