Press "Enter" to skip to content

ওমিক্রনের ত্রাসে বর্ষবরণ, সত্যিই কি নতুন বছর ২০২২?….

Spread the love

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় ; কলকাতা, ৩ জানুয়ারি ২০২২। ৩৬৫দিনের পর আবার নতুন বছর সেলিব্রেট করলো বিশ্বের মানুষ। কিন্তু করোনায় কাহিল মানুষের নতুন ত্রাস ওমিক্রন। বিশ্বের সঙ্গে সংক্রমণ এদেশেও বাড়ছে। বাংলাও ব্যতিক্রম নয়। তবে উৎসব আনন্দ কি থমকে যাবে? না। মেরেছো কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেবো না। উল্লাসে মেতেছে মানুষ। হুজুগে বাঙালিও বাদ যায়নি। বাঙালির কাছে জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য। কাল ক্যায়া হোগা, কিসকো পাতা, আভি জিন্দেগি কো লে লো মজা। বাঙালি দার্শনিকও বটে।

নতুন বছর রসেবসে থেকে পালন করাই ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিরকুমার সভায় তো কবেই বলে গেছেন, দেশে অন্ন জলের হল ঘোর অনটন, খাও হুইস্কি সোডা আর মুরগি মটন। অন্যত্র আবার লিখেছেন, অভয় দাও তো বলি, আমার উইশ কী_ একটা ছটাক সোডার জলে বাকি তিন পোয়া হুইস্কি। স্বয়ং বিবেকানন্দও নাকি লন্ডনের উইলসন হোটেলে চেখে দেখেন মদিরা।

বাঙালি মাত্রই বুদ্ধিজীবী। তাই ঐতিহ্য রক্ষা করার একটা দায় থেকেই যায়। মদিরা ছাড়া উৎসব পালন সেতো নুন ছাড়া রান্নার মতো। তাছাড়া মদিরা ঐতিহ্য তো বাংলায় নতুন নয়। বাংলার এক অংশের নাম ছিল গৌড়। গুড় নির্মাণে এক কালে বাংলার খ্যাতির কথা কে না জানে? পাটালি তো বাংলার অহংকার। আর গুড় থেকে বাংলা মদ, সেতো বাঙালির জাতীয় পানীয় ছিল। ইংরেজরা এদেশে এসে নববর্ষ পালন করতেন হুইস্কির সঙ্গে বাংলা পাঞ্চ করে। কোলকাতায় গড়ে উঠেছিল পাঞ্চ হাউস। যা থেকে পাব শব্দের উৎপত্তি। ১৯শতকে কলকাতার ওষুধের দোকানে বা ডাক্তারবাবুর চেম্বারেও মিলত মদ।

আরও যদি পিছিয়ে যান সময়কে সঙ্গী করে, সেখানেও দেখবেন মদমত্ত মানুষের মাদকতা। বৈদিক যুগে সুরার ছিল অষ্টতর শতনাম। সোম, মদ্য, মদিরা, মধুসাধু আসব, কাদম্বরী (কদমফুল থেকে মিশ্রিত মদ), বারুণী আরও অনেক নাম। কোনও ঠেকে মদ পরিবেশন হলে বলা হতো পানগোষ্ঠিকা। আসান। পানপাত্রকে বলা হতো চষক, সরং, অনুতর্ষণ। রামায়ণে উত্তরকাণ্ডে শ্রীরাম সীতার হাতে মৈরেয় মদ তুলে দিয়ে নাকি বলেছিলেন, সীতামাদায় হস্তেন মধু মেরেয়কা শুচি। মহাভারতের বীরশ্রেষ্ঠ ভীমও নাকি পছন্দ করতেন বিয়ার। মদিরার বিশেষ এক পদ। আয়ুর্বেদে ৮৪ রকম মদের উল্লেখ আছে। কুলার্ণবতন্ত্রে বলা হয়েছে, আমের মদ বিদ্বান করে।

ইংরেজ যখন গুটি গুটি পায়ে দেশ ছাড়ছে,তাঁদের সঙ্গদোষে শহরের নেটিভ গণ্যমান্য বঙ্গবাবুরা ক্লাব কালচারে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। টলি ক্লাব, ক্যালকাটা ক্লাব , বেঙ্গল ক্লাব, গল্ফ ক্লাব। কত ক্লাবের সভ্য হলেন বাঙালি। অবশ্য ওমিক্রনের নতুন আক্রমণে সমাজের ওপরতলার মানুষ এবার আর ক্লাবে যাচ্ছেন না নববর্ষ পালন করতে। তাই বলে মধ্যবিত্ত বাঙালি পিছিয়ে যাবে, এমন দুর্বল চিত্ত নয় তাঁদের। ইংরেজি নববর্ষ পালনের একটি বৃটিশ প্রদত্ত অধিকার ভারতীয় তথা বাঙালির এখন গর্বের বস্তু।

তাছাড়া বিশ্বায়নের জেরে ইংরেজি নববর্ষ তো এখন বিশ্বজনীন। বর্ষবরণের হাজারও রীতি। বাঙালি মধ্যরাত পর্যন্ত আলো ঝলমলে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের রাস্তা ধরে হাঁটবে মাস্কবিহীন মুখে। যে বাঙালির অক্ষর জ্ঞান এখনও পোক্ত হয়নি সেও আর একজনকে দেখে বলবে, হ্যাপি নিউ ইয়ার। এই প্রতিবেদকের কাছে পার্ক স্ট্রিটের আর একটি নাম থাকা উচিত মনে হয়েছে। সেটি হলো সুরা সরণী। অথচ রাজ্য প্রশাসন এই পথের নাম দিয়েছেন মাদার টেরিজা সরণী। সেটাও শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিতে হয়। স্কচ, হুইস্কি ভদকা, বিয়ার ছেড়ে বাঙালি এখনও বুর্গনিয়ো, বোরদ্যুয়ু, রোন,আলসেস মোসেল, শঁপাইন বা ইতালির চিয়ন্তি খেতে শেখেনি। টার্কি রোস্ট খেতে শিখেছে। অক্টোপাস বা স্কুইড খেতে শিখেছে। কিন্তু মেক্সিকোর রোসকা দিরেস রুটি বা তামালে পিঠে, কিংবা ফ্রেঞ্চ ফয়ে গ্রাস, ব্যগুয়েট, জার্মানির সেউর ক্রত, হেরিং মাছের ডিম ভাজা বা নেপোলিয়ন কেক এখনও খেয়ে ওঠেনি। তবে বাঙালি বিশ্বের সেরা অনুকরণকারী হিসেবে ইতিমধ্যেই নিজের স্থান করে নিয়েছে। সুতরাং বাংরেজ বাঙালি অল্পদিনেই বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠবে এতে সন্দেহ নেই। শুধু বাংলাটা কেন ইংরেজিতে পড়ানো হয় না বলে বঙ্গমাতারা আক্ষেপ করবেন। বাঙালি এখন ঘরে ঘরে বড়দিনে খ্রিস্টমাস ট্রি সাজায়। নববর্ষের দিনে যতটা সম্ভব বাংলা সরিয়ে রেখে হিন্দি আর ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে মনোযোগ দেয়। বিশ্বের অন্যত্র মানুষজনও স্থানীয় রীতিতে নববর্ষ পালন করেন।

সুইজারল্যান্ডের মানুষ তো আবার নববর্ষের প্রথম দিনে সারা ঘরে আইসক্রিম টুকরো ছড়িয়ে রাখেন।আয়ারল্যান্ডের মানুষ দেয়ালে পাঁউরুটি ছুঁড়ে অশুভ আত্মা তাড়ান। কলম্বিয়ার মানুষ নববর্ষে স্যুটকেস একটা কিনবেনই। ডেনমার্কে অব্যবহৃত বাসন ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২ টার আগে পড়শির ঘরের দরজার সামনে কার্তিক ফেলার মত গোপনে ফেলে আসেন।স্পেনের নিয়ম, বর্ষ শেষে রাত ১২ টা বাজলেই ১২ টি আঙ্গুর খেয়ে নববর্ষ পালন করা। বলিভিয়ায় কেকের মধ্যে পয়সা লুকিয়ে রাখা হয়। কেক খেতে গিয়ে যিনি পয়সা পান, তাঁর জন্য বছরটি হয় সৌভাগ্যের। রোমানিয়ার মানুষ গরুর কানে কানে শুভেচ্ছা জানান। পুয়ার্তরিকোর মানুষ ঘরে রাখা বালতির জল জানলা দিয়ে বাইরে ফেলেন। দেশে দেশে এমন আজব রীতি পালিত হয় নববর্ষ ঘিরে।

কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়। নতুন বছর ২০২২কি সত্যিই ২০২২? গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের সময় থেকেই মানুষের ধারণা, আমরা কেবল বর্তমানেই বেঁচে থাকি। কসমোলজিস্ট বৈজ্ঞানিকদের ধারণা , সময় আসলে একটি কল্পনা। গ্রেগ্রিয়ান ক্যালেন্ডারের ঐতিহ্যকে সম্বল করে আজও ৩১ডিসেম্বর বর্ষবিদায়ের দিন হিসেবে মেনে চলেছি। মায়ের নাড়ির বন্ধনকে ছিন্ন করে জীবনের প্রথম আলো দেখে যে পথ চলা আমাদের শুরু ,তার অবসান কোনও এক সময়ে। কোনও এক দিনে। প্রতি বছর সেই দিনটি পেরিয়ে যাই নিজের অজ্ঞাতে। কোনও এক চিন্তাবিদ যেন বলেছিলেন,আমরা মৃত্যুর দিকে রোজ এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছি। একটি বছর অতিক্রান্ত মানে জীবনের ভাঁড়ার ঘর থেকে একটি বছর খরচ। জন্মদিন বা নববর্ষে যেন আমরা সেই আগত মৃত্যুর সময়কে স্মরণ করে আনন্দে পালন করি । জন্ম মৃত্যু পায়ের ভৃত্য।

ক্যালেন্ডি গ্রিক শব্দের অর্থ মাসের প্রথম দিন। তারই ইংরেজি শব্দ ক্যালেন্ডার। যীশুর জন্মের তিন হাজার দুশো বছর আগে যে ক্রো ম্যাগনান গোষ্ঠীর লুনার ক্যালেন্ডারের হাত ধরে সময়ের নিরিখে দিনক্ষণ কষা হলো তার এখন পর্যন্ত সর্বশেষ পরিণতি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। পেশায় আইনবিদ ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরি ১৫৭৭ সালে প্রথম ক্যালেন্ডার সংশোধনের কথা বলেন। কেননা আগের জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ভুল গণনার ফলে চার্চগুলিতে ইস্টারের দিন ঘোষনায় গোল বাঁধল। পোপ গ্রেগরি ১৫৮২ সালের ৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার থেকে পরের দিন শুক্রবার তারিখ বদলে করেন ১৫ অক্টোবর। এখানে তারিখের ফারাক ঘটলো।

অন্যদিকে গ্রিক পণ্ডিতেরা গণনা করে জানালেন , সম্রাট জুলিয়াস সিজার যীশুর জন্মের বছর ধরে যে বর্ষ ঘোষণা করেছিলেন, তা ছিল ভুল। যীশুর জন্ম তার কয়েক বছর আগেই হয়েছিল। ডেল আরভিন ও স্কট সানকিস্ট তাঁদের গবেষণালব্ধ গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ক্রিশ্চিয়ান মুভমেন্ট’ এ লিখেছেন,৩০০ খ্রিস্টাব্দের আগে যীশুর জন্মদিন নিয়ে কোনও ঐক্যমতই ছিল না। সুতরাং এক কাল্পনিক গণনার ফল চলতি বছর ২০২১ । স্বয়ং পোপ ষোড়শ বেন্ডিক্ট তাঁর ‘জেসাস অফ নাজারেথ’ গ্রন্থে স্পষ্ট লিখেছেন, যীশুর জন্মদিন ও বছর নিয়ে গণনার ভুল থেকেই গেছে। ফেলে আসা বছর যেমন ২০২১ নয়, তেমনই নতুন বছর ২০২২ নয়। কমপক্ষে দু চার বছরের এদিক ওদিক আছে। আমরা কল্পনার ভিত্তিতেই একটা ভুল গণনায় নতুন বছর পালন করে চলেছি।

More from LifestyleMore posts in Lifestyle »
More from SocialMore posts in Social »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.