শ্রীজিৎ চট্টরাজ / গোপাল দেবনাথ: কলকাতা, ৫ জুন ২০২২। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত অনীক দত্ত পরিচালিত অপরাজিত ছবির দৌলতে বাঙালি চাক্ষুষ একটি অভিজ্ঞতায় জেনেছেন, সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী ছবি নির্মাণ খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের আনুকূল্যে অর্থ সাহায্য যেমন ছবিটি সম্পূর্ণ হয়েছিল, তেমনই বিধান রায়ের অনুরোধেই সে যুগের বাংলা ছবির প্রথমসারির প্রযোজক ও পরিবেশক অনাদি বসু পথের পাঁচালী পরিবেশনের দায়ভার নেন। এরপর তো সবটাই ইতিহাস।
১৯০৬ সালে অনাদি বসু প্রতিষ্ঠা করেন ম্যাজিক থিয়েট্রিকাল কোম্পানি। এরপর পরিবর্তিত রূপ অরোরা ফিল্ম কোম্পানি। বিবর্তনের ইতিহাস বেয়ে সংস্থা স্থিতু হয় অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশন নামে। সময়টা ১৯২১ সাল পরাধীন দেশ। ১৯৮৬ তে ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডে মানিকতলা’র অরোরার নিজস্ব স্টুডিও যায় পুড়ে। ঐতিহাসিক ছবির অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেলেও দমে যাননি পরবর্তী প্রজন্মের অজিত বোস ও অরুণ বোস।
এস ওয়াজেদ আলীর কথামত সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে সূত্র রক্ষা করেছেন এখন অনাদি বসুর পৌত্র সর্বজনপ্রিয় অঞ্জন বসু। চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে তাঁর নাড়ির টান। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, প্রমথেশ বড়ুয়া’র কাহিনী চিত্র নির্মাণ বা পরিবেশন নয়, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী বা নেতাজির মূল্যবান তথ্য সেলুলয়েডের গুপ্তধন অরোরার সংগ্রহে আজও আছে। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা উদযাপন ,রবীন্দ্রনাথের শেষকৃত্য সেলুলয়েডে বন্দীর দাবিদারও অরোরা স্টুডিও। ভারতের প্রথম শিশুচিত্রের নির্মাতা যেমন এই সংস্থা, তেমনই এই সংস্থার তৈরি রাজা রামমোহন ছবি প্রথম বাংলার করমুক্ত ছবি। ভগিনী নিবেদিতা এক এমন বাংলা ছবি, যা বাংলা ছবির ইতিহাসে স্থান পেয়েছে প্রথম বিদেশে অর্থাৎ ইংল্যান্ডে চিত্রগ্রহন করার ইতিহাস নিয়ে।
১৯৭৫ সালে উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ময়না তদন্ত ছবি ছিল অরোরার শেষ প্রযোজনা। এরপর দীর্ঘ দিনের পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি নির্মাণ বা পরিবেশনে লম্বা বিরতি। তবে সংস্থার কর্ণধার অঞ্জন বাবু তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজ করে গেছেন। সম্প্রতি ‘কালকক্ষ’ ছবি নির্মাণ নিয়ে সূচনা হয় নতুন করে পথ চলার। জহুরী যেমন হীরে চিনতে ভুল করেন না, তেমন অঞ্জন বোসও ভুল করেননি। নতুন প্রজন্মের সিনেমা শিল্পের বৃত্তি শিক্ষায় দক্ষ পরিচালকদ্বয় শর্মিষ্ঠা মাইতি ও রাজদীপ পালের হাতে দায়িত্ত্ব সঁপে ছবি নির্মাণ করেন কালকক্ষ। যা মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুনলেও ইতিমধ্যে বিদেশ থেকে পুরস্কার ছিনিয়ে এনেছে অসংখ্য। দেশেও মিলেছে এই সিনেমার স্বীকৃতি।
গত ৩ জুন শুক্রবার বিকেলে মধ্য কোলকাতার ঐতিহ্যময় অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশনে সংস্থার অফিসে নতুন ছবি মন পতঙ্গ ছবির শুটিংয়ের ফাঁকে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সংস্থার কর্ণধার অঞ্জন বোস ছবির নির্মাণের কথা ঘোষণা করলেন। ইতিমধ্যেই ছবির প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এই ছবিরও পরিচালকদ্বয় শর্মিষ্ঠা মাইতি ও রাজদীপ পাল। প্রথম ছবির উৎকৃষ্টায় আস্থা অর্জন করে পরিচালকদ্বয় তাঁদের নতুন কাজ করছেন। ছবির এক মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করতে অসম থেকে এসেছেন, ব্যান্ডিড কুইন ছবি খ্যাত সীমা বিশ্বাস। সে ছবিতে ডাকাত রাণী ফুলন দেবী চরিত্রে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে যেমন জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন, তেমন ঐতিহ্যময় বেসরকারি পুরস্কারও লাভ করেছেন সীমা বিশ্বাস। এই ছবিতে তিনি এক চায়ের দোকানির চরিত্রে অভিনয় করছেন। প্রযোজক অঞ্জন বোস তাঁর দুই পরিচালক, অভিনেত্রী সীমা বিশ্বাস ও ছবির অন্যান্য শিল্পী ও কলাকুশলীদের নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করলেন।
প্রতিবেদকদের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রযোজক জানালেন, এশিয়ার সবচেয়ে আধুনিক স্টুডিও নির্মাণের কাজ চলছে অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশনের উদ্যোগে। পাশাপাশি সুস্থরুচির ছবি নির্মাণ। আগামীদিনে ছবি নির্মাণ, পরিবেশনার পাশাপাশি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের পরিকল্পনাও আছে। মল সংস্কৃতির জোয়ারে সিঙ্গল স্ক্রিন এখন ডোডো পাখি হতে চলেছে। সুস্থরুচি ও বাংলার সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ প্রযোজক ও সিঙ্গল স্ক্রিনের পুনর্জন্ম হলেই বাংলা ছবি হৃত সম্মান ফিরে পাবে। পরিচালকদ্বয় জানালেন, ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ব্যবস্থায় এক দম্পতি একটি দোকানে লোভনীয় একটি চেয়ার দেখে আকৃষ্ট হন। দুজনেই সেই চেয়ার নিজেদের মধ্যে পেতে চান। চেয়ার অর্থে ক্ষমতার প্রতীক। যা নিয়ে বিশ্ব তোলপাড়। ছবির পরিণতি জানতে হলে অবশ্যই অপেক্ষা করতেই হবে।
ছবির চরিত্রলিপিতে আছেন সীমা বিশ্বাস, শুভঙ্কর মোহন্ত, বৈশাখী রায়, অমিত সাহা, অনিন্দিতা ঘোষ, জনার্দন ঘোষ, ত্রিবিক্রম ঘোষ, অনিন্দ্য রায় প্রমুখ। ছবির ডি ও পি রানাপ্রতাপ কারফর্মা, সঙ্গীত পরিচালক অভিজিৎ কুণ্ডু, কার্য নির্বাহী প্রযোজক প্রতীক বাগি।
Be First to Comment