///////[প্রদীপের সঙ্গে আলাপ=প্রলাপ]\\\\\\\\ ((((((পর্ব- ৭০))))
[ মনোবিদ, মঞ্চ-মায়াবী পি সি সরকার জুনিয়র] =Dr. Prodip Chandra Sorcar, M. Sc., Ph. D.=
——————————————————————
SHOW BUSINESS MANAGEMENT *************মায়া-দেবীর সাধনায়************* •••••সরস্বতীর পূজো করে লক্ষ্মী-লাভের উপায়••••
অনেক অভিজ্ঞ ব্যক্তিই আমাকে ভুরু কুঁচকে, ব্যাঙ্গের হাসি চেপে, দুঃখ- দুঃখ মুখে অভিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করেন, “আচ্ছা, সরকার মশাই, ম্যাজিকের ভবিষ্যৎটা শেষ পর্যন্ত কি হবে , বলুন তো!!? বিজ্ঞান যেভাবে এগুচ্ছে, তাতে, ভবিষ্যতে কেউ তো আর ম্যাজিক-ট্যাজিক দেখতেই চাইবে না !!!”
একবার, এই কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ‘দুম্-ফটাস্’ করে একটা আওয়াজ হয়েছিলো। সুপারসনিক সাউন্ডে ভেন্ট্রিলোকুইজম্ করে উনি নিজেই সেটা করেছিলেন, সেজন্য, ভদ্রতার খাতিরে, দৃশ্যপট সামাল দিতে, আমি দু-হাত বাড়িয়ে, খপ্ করে ওনাকে জড়িয়ে ধরি। কারণ বুঝেছিলাম, উনি আসলে বলতে চাইছেন, ম্যাজিকের দুঃখে ওনার বুকটা ফেটে একেবারে দুম্ ফটাস্-চৌচির হয়ে গেছে। আমি না ধরলে হয়তো আরও বিপদ হতো। লজ্জায়, দুঃখে উনি মাটিতে মিশে যেতে পারতেন। তাতে পিচ্ছিল কাদাময় হতে পারতো আমাদের সুন্দর ঝা চকচকে শিল্পের আঙ্গিনা। পরের দিন হয়তো কাগজে ছাপতো, “ম্যাজিকের দুঃখে বাঙালি সমঝদারের প্রাণ ত্যাগ…বুক ফাটা আর্তনাদ এবং গুলির ‘গরাম’ শব্দের উৎস-সন্ধানে এবং দুষ্কৃতীর মোকাবেলায় হাফ ব্যাটেলিয়ন আধাসেনা বাহিনী, আ্যন্টি-এয়ারক্রাফ্ট মেশিন গান নিয়ে হাজির। খুনের কারণ জানতে, প্রয়োজনে অত্যাধুনিক মগজাস্ত্র ব্যবহারে , ঠিক জেমস্ বণ্ডের মতো ‘লাইসেন্সড্-টু-কিল’ সার্টিফিকেট সমেত ফেলু-দাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। উনি নি:শব্দে সাইকেলে করে এসে সবার ফিঙ্গার প্রিন্ট সংগ্রহ করছেন, প্রশ্ন করছেন, “ফিঙ্গার প্রিন্টের আবিষ্কর্তার নাম কে কে জানেন? বলুন।” তবে যে যাই বলুক, এই নৃশংস খুনের জন্য সপরিবারে পি. সি. সরকার জুনিয়র দায়ী বলে দাবি করছেন সাংবাদিক বাহিনীর একাংশ।”
হয়তো বা টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে দেখাবে, বলবে. “. ..ঘটনাস্থলে আমাদের রিপোর্টার ‘রাজ জ্যোতিষী’র কাছ থেকে পূর্বাভাস পেয়েই হাজির হয়ে…আমরা একদম জিরো পয়েন্ট থেকে, প্রাণ হাতে নিয়ে দেখাচ্ছি… হ্যাঁ, রিপোর্টার পদ্মলোচন, তুমি এখন কী দেখতে পাচ্ছো..জানাও । একজনকে দূরে দাঁড়িয়ে দু-হাত তুলে , বড়ো ‘হা’ করে আড়মোরা, নাকি কি যেন বলে, সেটা ভাঙ্গতে দেখা যাচ্ছে। ওনাকে কি ‘Hands-Up’ করতে বলা হয়েছে? খোঁজ নাও। সেটা কে বলেছে ? কজন লোক ছুটে পালিয়েছে ? গুণে জানাও”। কজন ক্যামেরায় মুখ দেখাতে উকি-ঝুকি মারছেন, তুমি বিস্তারিত ভাবে তাদের জন্ম- পরিচয়, ডেট অফ বার্থ জানাও।… ”
বুঝতেই পারছেন, আমি খেপে রয়েছি। রেগে আছি, কারণ বঙ্গ-ভূমির আমরা বাঙালিরা তো বরাবরই হাড়-হাভাতে বজ্জাত আর নীচু রুচির মানুষ ছিলাম। এখানে এলে ধর্মমতে জাত যেতো। পুন্যেষ্টি যজ্ঞ করে জাত ফেরত পেতে হোতো। কিন্তু এই এতোটা ‘ম্যাল্লোছ’ ছিলাম না। হয়তো ছিলাম কিন্তু সেটা রাজায়-গজায় ছিলো, কিন্তু এমন ‘ঠিকে ঝি’ ভার্সেস ‘ওবাড়ির চাকর’ মার্কা ঝগড়া, খিস্তি-খেউর এবং চেঁচিয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে, নিত্য নতুন কাহিনীর মিথ্যের স্টকের ব্রডকাস্টিং জন নেতা নেত্রীদের মধ্যে ছিলোনা। এমন কী ঘটলো যাতে এতটা অধঃপতন ঘটলো আমাদের এই কাঙালি, sorry, বাঙালি নামক বহুতল বস্তিবাসীদের। !!?
বরাবরই আমরা ভালোয়- মন্দোয় মেশানো জাত ছিলাম। হ্যাঁ, ওই ভদ্রলোকেরও হয়তো কোন দোষ নেই। আর পাঁচ-দশটা সবজান্তা বাঙালির মতো, তিনিও একেবারে নির্ভেজাল পাণ্ডিত্য প্রকাশের জন্যই ,বোকা বোকা প্রাথমিক প্রশ্নের মোড়কে , খোঁচা মারার বরাবরের অভ্যাসটা , তাঁর নিজের অজান্তেই প্রকাশ করে ফেলে ছিলেন। না, এটা ওনার ব্যক্তিগত কোনও আলাদা বিশেষত্ব নয়। সমগ্র বাঙালি জাতিরই চরিত্র। আমি এ ব্যাপারে ১০০% সুনিশ্চিত। কারণ আমি নিজেই একজন বাঙালি। বংশ পরম্পরায় খাঁটি বাঙালি। নিষাদ-অস্ট্রিক- তামিল ধারা আমার রক্তে ফুল স্পিডে বহমান। আমাদের নকল ‘দোস্তি’ এবং ভূয়ো ‘সহানুভূতি’শীল ধর্ষকামী চরিত্র প্রকাশে এ এক সাবেকী বিশেষত্ব। “উয়ারে শিয়ালে খাইয়াছে” বলে ফোড়ন কাটাটা আমাদের জাতীয় চরিত্র। আর সেজন্যই তো বঙ্কিম-সাহিত্যে স্থান পেয়েছে।
আরে বাবা, আমি কি গণৎকার জ্যোতিষী, যে আকাশের তারা-নক্ষত্র-দ্রোণ বা স্যাটেলাইটের পজিশন দেখে , ভবিষ্যতের মানুষ মহাজাতি সদনের সামনে কতো লম্বা লাইন দেবে, বা, অন লাইনে টিকিট কাটবে, সেটা বলে দেবো? আর শুধু তা নয়, বললেই উনি সেটা, মেনে নেবেন বা বুঝে ফেলবেন , এতটা বিরাট এক সোসিওলজিস্ট, ইকোনমিস্ট, মনোবিজ্ঞানী, শিল্প-স্রষ্টা এবং সহমর্মী আপনজন কি তিনি ?।
এটাই আমাদের সামাজিক বৈশিষ্ট্য। আমরা ঠি-ক ,এ—ই রকম। না জেনে-বুঝে ফোড়ন কাটি। পাঁচ ফোড়নেও আঁশ মেটেনা, চাই বিশ ফোড়ন। বাক্যে বিস্ফোরণ, ফলশ্রুতি? হয়েছি ঘেঁচু কলা । একেবারে সর্বঘটের শেষ, মজে যাওয়া ক্যাত ক্যাতে কালো নরম এক কাঠালি-কলা। অগ্রদানী বামুনও পুটলীতে পুরবে না।
কিন্তু, কেউ যদি আমাকে এই প্রশ্নটাই ভালো, পরিষ্কার মনে , অর্থাৎ সুস্থ ভাবে, সোজাসুজি, করতেন? আমি তখন রাগ করতাম না, বরঞ্চ তাঁকে হেসে বলতাম , “ম্যাজিকের ভবিষ্যৎ যদি খারাপই হয়, তাহলে আমার বাবা কি আমায় ম্যাজিক করতে দিতেন? নাকি, আমি আমার মেয়েকে দিতাম ম্যাজিক করতে ? ও নিজেই তাহলে এড়িয়ে গিয়ে অন্য কিছু করতো। তা তো করেনি !! কেউ কি তার সন্তানকে বিপজ্জনক ,ঝুঁকির দিতে ঠেলে দেয়? সব্বাই চায় ‘আমার সন্তান-সন্ততি যেন, থাকে দুধে ভাতে! ‘ কেউ খারাপ চান না। আমি জানি ও পারবে। করার মতো অনন্তসম ধৈর্য্য, শক্তি, বিদ্যেবুদ্ধি, সম্ভাবনা এবং চাহিদাও রয়েছে স্তরের পর স্তর।
হিংসে কোরো না । চেষ্টা করো, তোমারও হবে।
এই ভাবেই কথোপকথন এগুতো। এমনটাই তো হওয়া উচিত। উনি বলতেন:-
—-“তার মানে, ম্যাজিকের ভবিষ্যৎ খারাপ নয়, উজ্জ্বল! ”
—-“হ্যাঁ, তা তো বটেই। অন্যান্য প্রতিটি আর্ট-এর মতোই, শিল্পীর দক্ষতা, প্রতিভা, পরিচালন-পদ্ধতি, পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে সেই আর্টের ঔজ্জ্বল্যের পরিমাণ। ডারউইন-এর ফর্মূলা অনুযায়ী হবে Survival for the fittest. অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে লড়ে, যদি মানুষের মনকে জয় করতে পারো তো বাঁচো। না পারলে, মরো।”
আমি তো দেখছি, অন্যান্য পারফরমিং আর্ট এখন বাঁচার তাগিদে, ম্যাজিকের কাছেই হাত পাতছে। এ যেন,”কানু ছাড়া গীত নাই” -এর মতো “ম্যাজিক ছাড়া মজা নাই”, হয়ে গেছে পুরো রঙ্গজগত। ম্যাজিক মানে ওই রুমাল থেকে পায়রা বের করা বা কোটের পেছন থেকে ভাঁজ করা স্প্রিং ছাতা পটপটাং করে খুলে বের করে স্টেডিয়াম ছড়ানো বা টেবিল ক্লথের একটা কোনা ধরে টেবিলটা ভাসিয়ে নাচিয়ে স্টেজে ঘুড়ে বেড়ানো নয়।ম্যাজিকে থাকতে হবে প্রকৃত অর্থে , জাদু দৃশ্য কাব্যের ছোঁয়া, শিহরণ জাগানো উপস্থিতি, তার বাধন-ভাঙ্গার অবিশ্বাস্য নতুন চমক, আশার সীমানার বাইরে চলে যাবার ধৃষ্টতা, সেই অলীক ম্যাজিক-রিয়্যালিজমের পরিবেশ সৃষ্টি করা, মানুষকে সেখানে নিয়ে পৌঁছে দেওয়া। দক্ষ বাদ্যকর সেখানে পৌছুতে যে যাদুর শরণাপন্ন হন। দক্ষ জাদুকরদের সেই যাদুর পর্যায়ে পৌছুতে হবে। এর তলায় বিচরণ করলে সেই আর্টের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে। আমার বলতে খারাপ লাগছে, বর্তমানের বহু ‘জাদুকর’ দুর্ভাগ্যক্রমে ওই তলানীর স্তরেই রয়ে গেছেন। সেজন্য, বেচারা, ওরা ফ্রাস্ট্রেশনের জগতেই রয়েছেন আটকে।
কারণ?
অদ্ভুত এই কারণ।
ম্যাজিক তো আর মন্ত্র-টন্ত্র দিয়ে হয় না, তার পিছনে মনোবিজ্ঞান ভিত্তিক কৌশল আছে। সেই কৌশল গুলো সাধারণতঃ হয়ে থাকে যাণ্ত্রিক। অনেকদিন ধরে অভ্যাস করে কায়দা আয়ত্ব করে মানুষ কে চমকানোর চেয়ে যণ্ত্র দিয়ে চট জলদি যদি চমক লাগানো যায়, তাহলে তো অনেক সহজেই জাদুকর হওয়া যায়।এই মানসিকতার থেকেই সৃষ্টি হয় চমকটা আর্টে রূপান্তরিত করার প্রতি অনীহা। এতে প্রয়োজন হয় শুধু কয়েকটা জিনিষ জানা।
(1) সেই দোকানটার ঠিকানা সংগ্রহ করা।
(2) কি কি ম্যাজিক বিক্রির আছে, সেটা জানা।
(3) কতো দাম সেটা জানা।
(4) লেখাপড়া বন্ধ করে যণ্ত্রটা কিনে ফেলা।
(5) যণ্ত্রটার ব্যবহার করতে না জানা।
(6) সেটাকে নিজে করে দেখতে টিচার রাখা।
(7) দর্শকদের সামনে করে দেখানো।
(8) দর্শকদের সামনে বিফল হওয়া, ফাঁশ হওয়া।
(9) অন্য কেউ দেখাবার সময় কৌশল ফাঁশ করা।
(10) নিজের যণ্ত্র কপি করে বিক্রি করে দেওয়া।
(11) নিজে একটা ম্যাজিকের দোকান খোলা।
(12) নিজে শিল্পী হতে না পেরে, টিচার হয়ে বসা।
(13) একটা দঙ্গল বানিয়ে ম্যাজিকের ক্ষতি করা।
[[[[[[[[[[To be continued as (পর্ব-০৭১) ]]]]]]]]]]]
Be First to Comment