ইন্দ্রজিৎ আইচ : কলকাতা, ১৯ এপ্রিল ২০২১। সম্প্রতি একাডেমি তে চন্ডীতলা প্রম্পটারের 21তম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে দুটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। ছোটরা অভিনয় করে সুকুমার রায়ের অবাক জলপান নাটক টি।
বহুল আলোচিত অভিনীত নাটক হলেও নির্দেশক প্রদীপ রায়ের তুলির টানে উপস্থাপনার শৈল্পিক মূর্ছনায় নাটকটির মঞ্চায়ন আগাগোড়া একটি নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত হয়।শুরুতেই দর্শকদের টানটান বসিয়ে রাখার জন্য সূত্রধর কে এনে বুঝিয়ে দেন এই নাটকটি আজও কেন প্রাসঙ্গিক। একটি কোটেশন ব্যবহার করেছেন “একটি শব্দের দুটি অর্থ হওয়ার জন্য আমাদের কিভাবে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তারই জলন্ত শিল্পসম্মত উদাহরণ এই নাটক।” সূত্রধর এর চরিত্রে অর্নব মুখোপাধ্যায় সাবলীল মুখবন্ধনে দর্শক হৃদয়ে দেখার বাসনা জাগিয়ে তোলে। তারপরই অসাধারণ নৃত্য শৈলী প্রদর্শিত হয়। পথিকেরা একটু জলের খোঁজে কি নিদারুণ ক্লান্তিকর পরিবেশের মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে তার চমৎকৃত দৃশ্যায়নে নাটকের গতি বাড়তে থেকে। কোরিওগ্রাফি তে প্রিয়াঙ্কার জবাব নেই। সুর করেছেন অয়ন আর গান বেঁধেছেন নির্দেশক নিজেই। ফলত পথিকের আগমনের পরিবেশ কে ফুটিয়ে তুলতে কোনও রকম আড়ম্বরপূর্ণ আবহ ব্যবহার করতে হয়নি। প্রচন্ড গরমে একটু জলের প্রত্যাশায় পথিককের সঙ্গে যেসব চরিত্রের সাক্ষাৎ হয় তাঁদের প্রত্যেকটিকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করে নির্দেশক এক একটি সমাজের বৈশিষ্ট্য কে মঞ্চে তুলে এনেছেন।প্রথম ঝুড়িওয়ালা কে হিন্দুস্তানী, দ্বিতীয় একটি বৃদ্ধা কে মঞ্চে এনেছেন যে কিনা শুধুমাত্র মামার গুনগান ছাড়া কিছুই জানেনা। একজন বৈষ্ণবী কে এনেছেন।সমালোচনা ছাড়া কিছুই চান না। একজন কবি ভাবাপন্য মানুষ যিনি সবেতেই মিল খুঁজে বেড়ান আর শেষে এমন একজন জল বিশেষজ্ঞ মানুষকে দেখিয়েছেন যে শুধুই জলের কষ্ট বোঝেনা বোঝে শুধুমাত্র জলের বিশ্লেষণ।শেষ মেষ কৌশল অবলম্বন করে ভাগনা র হাত থেকে জল খেয়ে প্রাণ বাঁচান।মামা তবুও বলেন এই জলের আকালে অপচয় করলেন? এই খানেই নাটকের স্বার্থকতা।সম্প্রীতা রায় চৌধুরী পথিক, আদিত্য রায় ঝুড়ি ওয়ালা, সপ্তবর্ণা আলু বৃদ্ধা, শ্রেয়শ্রী আচার্য্য বৈষ্ণবী, সত্যম ঘোষ কবি, ভাগনা-দেবজ্যোতি রায় ও মামা নীলাদ্রি রায় ও নাচে আরাত্রিকা, স্নেহা ও সমৃদ্ধি চৌধুরী – সবাই সাবলীল টানটান অভিনয় করে মাতিয়ে দিয়েছেন। ধন্যবাদ নির্দেশক প্রদীপ রায় কে।
এইদিন পরের নাটক টি ছিলো আরো মজার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বিনিপয়সার ভোজ”। ৫০ মিনিটের এই নাটকটির
নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রদীপ রায়
মঞ্চ ও আলো করেছেন চঞ্চল আচার্য্য এবং দেবু।
মেকাপ ও আবহ সমীর ঘোষ ও অয়ন রায় এর।
সহযোগিতায় ও পোশাক পরিকল্পনায় ছিলেন অপর্ণা রায়, অরূপ চৌধুরী “বিনি পয়সার ভোজ” নাটকে প্রদীপ রায় নির্দেশক হিসেবে একটা বিশেষত্ব আছে। নাটকের উপস্থাপনা করেন সূত্রধর কে দিয়ে। বিনি পয়সার ভোজ গল্পটিকে এমনভাবে নাট্যে রুপান্তর করেছেন আগা গোড়াই একটি মজার হাসির মোড়কে সামাজিকপ্রহসনের ছবির বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। উদয় বাবুর কথায় রাজী হয়ে ভোজন রসিক অক্ষয় বাবু তার ভাঙাচোরা বাগান বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে এসে যে যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল আপাতদৃষ্টিতে হাসির উন্মাদনা থাকলেও নিদারুণ যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি উন্মোচিত হয় তাঁর অভিব্যক্তি তে।
উদয় বাবু মঞ্চে উদয় না হলেও তার দীর্ঘদিনের একনিষ্ঠ চাকর চন্দ্রকান্ত র উক্তি থেকেই বোঝা যায় লোকটি পুরোদস্তুর আজকের সমাজব্যবস্থার নিরিখে ধাপ্পাবাজ ও গুলবাজ, হয় তিনি দেনা করে ফানটুসি দেখান নাহয় লোক ঠকানোই তার পেশা ।বিভিন্ন পাওনাদার দের আগমণ ই প্রমান করে দেয় যে এই প্রহসন আবহমান কাল থেকেই চলে আসছে। অক্ষয় বাবু নিপাট একজন সাধাসিধে ভোজন রসিক মানুষ।তার সঙ্গে যে ভাবে রসিকতা করাহয়েছে তা সত্যিই যন্ত্রণাদায়ক।খিদে চেপে ক্রমশ পাওনাদারের একটার পর একটা কুকথা সহ্য করেও মাহিনের পুরোটাকা দিয়েও নিস্তার পাননি উপরন্ত বিনা অপরাধে জেলে যেতে হয়। অক্ষয় বাবুর চরিত্রে নির্দেশক প্রদীপ রায় নাটকের গতিকে এমন চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে পৌঁছায় যে দর্শককে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টানটান করে রাখে। সূত্রধর তুহিনা চৌধুরী সাবলীল ভাবে মুখবন্ধনে নাটকের স্ফুলিঙ্গ কে এক ধাক্কায় উচ্চতার শিখরে নিয়ে যায়। দেখাযায় মঞ্চে অক্ষয় বাবু অপেক্ষায় রত।উদয় বাবুর ভৃত্য চন্দ্রকান্ত ওরফে কৌশিক মালের কাছ থেকে জানতে পারে যে উদয় হোটেল পানে গেছে বোধ হয়।এই “বোধহয় “অক্ষয় বাবুকে ভোজনের আকাঙ্খা ও প্রত্যাশার পারদ কে এতোটাই উন্মাদনায় ভরিয়ে তোলে যা প্রদীপ রায়ের একক অভিনয়ে তা চূড়ান্ত প্রকাশ পায়।খাবার স্বপ্নে বিভোর অক্ষয় যখন একের পর এক নানান পাওনাদার আগমনে নাজেহাল হতে থাকে।বুঝতে পারেনা উদয় বাবুর দেনার চাপ তাকে কেনো নিতে হবে।হোটেলের খাওয়ার খরচ, কাপড়ের দোকান থেকে ধার করে আনা কাপড়ের দাম, তিনমাসের বাড়িভাড়া আর স্যাকরার দোকান থেকে বউয়ের জন্য দুগাছা বলা নিয়ে এসে ফেরৎ না দেওয়ার খেসারত। নীরবে সব সহ্য করে মিথ্যে মিথ্যে সব দেন মিটেয়েও খাবারের প্রত্যাশা ছাড়েন নি।উদয় বাবুর প্রতি এতোটাই বিশ্বাস করেছিলেন। শেষ অবধি নিজের পয়সায় শুকনো মুড়ি খেয়ে মিছেই পুলিশের গুঁতো খেয়ে জেলে যেতে হয়। এই মর্মান্তিক দৃশ্য টি পুরোমাত্রায় বজায় থাকে নাটকটিতে।মলয় বেরা-হোটেল বয়, বিনাপানী বস্ত্রালয় এর কর্মচারী-কৃষ্ণেন্দু ভট্টাচার্য, বাড়িওয়ালা- অনিমেষ পাঁজা , স্যাকরার দোকানের কর্মচারী-স্বজন সৃজন, দারোগা মলয় ঘোষ ও সেপাই সুরজিৎ কোলে- প্রত্যেকের টান টান অভিনয়ে নাটকটি সুচারুভাবে ফুটে ওঠে। কোরাস গান, আলো ও আবহ সর্বাঙ্গীন সুন্দর। মঞ্চে চঞ্চল আচার্য্য প্রশংসা প্রাপ্য। টানার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
এইদিনের দুটি নাটক” অবাক জলপান” ও “বিনি পয়সার ভোজ” সকল দর্শকদের মন জয় করতে পেরেছে ।
Be First to Comment