জন্মদিনে স্মরণঃ জ ন ডে ন ভা র
বাবলু ভট্টাচার্য : ‘কান্ট্রি রোডস টেক মি হোম/ টু দ্য প্লেস আই বিলং’- গানটি বেজে উঠলেই মনে হয় ভার্জিনিয়া এলাকার রুক্ষ শুষ্ক পাথুরে পথ চলে গিয়েছে এঁকেবেঁকে আর সেই পথে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে গানটা গাইছে এক নগর বাউল।
তার গানের সুর ঝংকারে উচু গাছের মাথা থেকে খসে পড়ছে শুকনো পাতা। পথের ধারের ঘাস-পাতায় রোদ এসে থেমে গিয়েছে। কাছের নদীটার নাম শেঁনাডোয়া, একটু দূরে নীল পাহাড়, খনিতে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটছে শ্রমিক আর হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে গান…
আরেকটি গান ‘ইউ ফিল আপ মাই সেন্সেস/ লাইক আ নাইট ইন দ্য ফরেস্ট/লাইক দ্য মাউন্টেন ইন স্প্রিং টাইম, লাইক এ ওয়াক ইন দ্য রেইন’।
কেবল কান্ট্রি রোডস কিংবা অ্যানি’স সং-ই তো নয়, ‘লাভিং অন আ জেট প্লেন’, ‘পারহ্যাপস লাভ’, ‘রকি মাউন্টেন হাই’, ‘পোয়েমস, প্রেয়ারস অ্যান্ড প্রমিজেস’, ‘হোয়াটস অন ইউর মাইন্ড’, ‘গ্র্যান্ডমা’স ফেদার বেড’, ‘সানসাইন অন মাই শোল্ডারস’, ‘ইফ এভার’, ‘ফলো মি’, ‘টু দ্য ওয়াইল্ড কান্ট্রি’, ‘ফ্লাই অ্যাওয়ে’, ‘সিজনস অব দ্য হার্ট’, ‘ইজ ইট লাভ’ ইত্যাদি জনপ্রিয় গানগুলি একসময়ে আপামর মানুষের হৃদয় দুলিয়ে দিয়েছিল। যার কথা, সুর ও কন্ঠে তিনি জন ডেনভার।
জন ডেনভারের বাবা ছিলেন বিমান বাহিনীর পাইলট। আর মা ছিলেন একজন সাধারণ জার্মান-আইরিশ ক্যাথলিক গৃহিণী। মা’র অনুপ্রেরণাতেই জন গানের জগতে আসেন। বাবার সৌহার্দ্যতা তেমন একটা না পেলেও তার গাওয়া গানে মা এবং আজন্ম শৈশবের ছবিই বারবার ফুটে উঠেছে।
একজন গায়ক হিসেবে ডেনভারের দুনিয়াজোড়া খ্যাতি হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, অভিনেতা, ফটোগ্রাফার, গীতিকার এবং শখের বৈমানিক।
বাবার কাজের সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হয়েছে জনকে। বাবার সেনাবাহিনীতে চাকুরির কারণে কোন জায়গাতেই খুব বেশিদিন থিতু হয়ে থাকতে পারেনি ডেনভারের পরিবার। তাই শৈশবে খুব বেশি বন্ধুও গড়ে ওঠেনি তার। এক জায়গা থেকে নতুন আরেকটি জায়গা এভাবেই ছুটে চলা ডেনভারের শৈশব।
জন ১২ বছর বয়সে গিবসন ব্র্যান্ডের একটি অ্যাকুয়েস্টিক গিটার উপহার পান দাদীর কাছ থেকে। এরপর থেকে শুধু গিটারের সঙ্গেই সখ্যতা তার। বিভিন্ন লোকাল ক্লাবে তখন থেকেই পারফর্ম শুরু করেন তিনি।
শুধু গান নয় অভিনয়েও কম পটু ছিলেন না জন। মাপেট শো-তে তিনি অতিথি শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৭৭ সালের দিকে নিজের অভিনয় প্রতিভা জাহিরের চেষ্টায় নামেন তিনি। ‘ওহ্ গড’ চলচ্চিত্রে তাকে অভিনয় করতে দেখা যায়।
উপস্থাপনাও করতেন জন। মোট ৫ বার গ্রামি অ্যাওয়ার্ডের হোস্ট হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৭৫ সালে কান্ট্রি মিউজিক অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ডেনভারকে ‘এন্টারটেইনার অফ দ্য ইয়ার’ পুরস্কার দেয়া হয়।
ডেনভার ছবি আঁকতেন। এমনকি ছবি তোলাও ছিল তার শখ। ছোটবেলা থেকেই খোলা আকাশটা তার প্রিয়। সঙ্গীতের পরে প্লেনে করে ঘুরে বেড়ানোটা ছিলো তার অন্যতম শখ। দ্রুত কনসর্টে যাওয়ার জন্য একটি জেট প্লেন কিনেন ১৯৭৪ সালে।
জনের মৃত্যুটাও হয়েছিলো প্লেন উড়াতে গিয়েই। ১৯৯৭ সালের ১২ অক্টোবর জন তার সদ্য কেনা রুটান লং ইজেড প্লেনটি পরীক্ষামূলকভাবে উড়ানোর সময় ক্যালিফোনিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে মারা যান।
প্রেম, প্রকৃতি, ভালবাসা, প্রতিবাদ ঘুরেফিরে এসে পড়ত ডেনভারের গানে। প্রতিবাদের কথায় অনেকেরই আপত্তি থাকবে, তবু সেই প্রতিবাদে থাকত শিকারি পাখি, দিগন্তহীন আকাশ, উপর থেকে দেখা রুক্ষ এক টুকরো সবুজ পৃথিবী। তবে হ্যাঁ তার প্রতিবাদে আগুন জ্বলে না উঠে এসে পড়ত মন খারাপ করা বিকেলবেলা।
চারণ কবিদের মতো ডেনভারের গানের কথা যেমন সহজ, সুরও চলত সরল পথে। তিনি প্রায় বলতেন যে গান গেয়ে মানুষকে কেবল বিনোদিত করতে চান না। তিনি তাদের ছুঁতেও চান। তিনি এও বলেছিলেন, তিনি কখনো হিট গান লিখতে চাননি। সব সময় ভালো গান লিখতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন সেখান থেকে কিছু বার্তা যাতে উঠে আসে। তবে নিজেকে তিনি পরম সৌভাগ্যবান বলে মনে করেন যে, তিনি জনপ্রিয় হয়েছেন।
তাহলে তিনি কেন গান গাইতেন? এর উত্তরে ডেনভার বলেছিলেন, তার গান গাওয়ার উদ্দেশ্য হল বাঁচতে গিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখা। তিনি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীতে আমরা সবাই একে অপরের জন্য। একে অপরের বিরোধিতা করার জন্য নয়।
জন ডেনভার ১৯৪৩ সালের আজকের দিনে (৩১ ডিসেম্বর) নিউ মেক্সিকোর রোজওয়েলে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment