জন্মদিনে স্মরণঃ মো হ ন দা স ক র ম চাঁ দ গা ন্ধী
বাবলু ভট্টাচার্য : এই উপমহাদেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন যিনি মহাত্মা গান্ধীর নাম শোনেন নি। কালো ছোটখাটো শুকনো মানুষটি ভারতের জাতির পিতা। অহিংস মতবাদ ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রবক্তা গান্ধী। ‘মহাত্মা’ তার উপাধি। মহান আত্মা যার। উপাধিটি দিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ধুতি চাদর পরিহিত নিরামিষভোজী যে গান্ধীকে আমরা জানি তিনি লন্ডনে পড়াশুনাকালীন সময়ে পুরোদস্তর সাহেব ছিলেন। নিয়মিত নাচ এবং বেহালা শিখতেন। কোট-টাই পরে সাহেবি কায়দায় ছড়ি ঘুরাতেন।
মা পুতলিবাঈ এবং দেওয়ান পিতার ঘরে গান্ধীর জন্ম। পুতলিবাঈ ছিলেন কঠিন ধর্মানুরাগী নারী। তিনি প্রতিদিন উপোস করতেন এবং নিরামিষাশী ছিলেন। ধর্মীয় অনুশাসনে গান্ধী বড় হন। যার ফলে গান্ধীর কখনোই কোন বদভ্যাস ছিল না বরং ছোটবেলা থেকেই মা তাকে জীবে দয়া করা, অহিংসা এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কথা শুনাতেন।
সারাবিশ্বের সকল নেতার অনুপ্রেরণার ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী ছোটবেলায় খুবই অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন। তিনি স্কুল শেষ হলে কোন রকমে দৌড়ে বাড়ি চলে আসতেন। কেননা সহপাঠীদের সাথে একেবারেই মিশতে পারতেন না। লজ্জায় মুখে কথাই আসতো না গান্ধীর, আর বন্ধুই বা বানাবেন কিভাবে! লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসেও গান্ধী সেই মুখচোরাই ছিলেন। ব্যবসায় প্রসার ছিল না। এমন উকিলকে কে চাইবে? অগত্যা তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি দিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধী একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানে দেনা আদায়কারীর চাকুরি পেয়ে যান। তখন দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল ব্রিটিশ এবং ডাচ শাসনাধীন।
ভারতীয়রা সংখ্যালঘু হওয়ায় বর্ণ বৈষম্যের শিকার হত। গান্ধী বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন এবং সত্যাগ্রহের ধারণা সেখান থেকেই শুরু। যে ঘটনাটি গান্ধীর ভেতরকার নেতৃত্বের আগুনটি জ্বালিয়ে দেয়–
ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট থাকা সত্ত্বেও তাকে কালো এবং ভারতীয় বলে ফার্স্ট ক্লাস কামরায় বসতে তো দেয়নি বরং বিষয়টি নিয়ে বিবাদ করায় তাকে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়। এই ঘটনাটি গান্ধীর মনে দাগ কেটেছিল।
স্বদেশী আন্দোলনের সময় সকল বিদেশি পণ্য বিশেষত ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা হয়। এর পথ ধরে তিনি সকল ভারতীয়কে ব্রিটিশ পোশাকের বদলে খাদি পরার আহ্বান জানান। তিনি সকল ভারতীয় পুরুষ ও মহিলা, ধনী ও গরিব মানুষকে দৈনিক খাদীর চাকা ঘুরানোর মাধ্যমে স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমর্থন করতে বলেন।
এটি এমন একটি কৌশল ছিল যা নিয়মানুবর্তিতা ও আত্মত্যাগের অনুশীলনের মাধ্যমে অনিচ্ছা ও উচ্চাকাঙ্খা দূরীকরণের পাশাপাশি আন্দোলনে মহিলাদের যুক্ত করে, এ সময়ে মহিলাদের করা এ সকল কাজকে অসম্মানজনক বলে মনে করা হত।
লবণের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করায় গান্ধী হাজার হাজার ভারতীয়দের সাথে পায়ে হেঁটে ডান্ডির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ইতিহাস একে Salt March বলে থাকে। শুধু মাত্র নিজ হাতে লবণ তৈরির জন্য পায়ে হেঁটে ১২ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত এলাহাবাদ থেকে ডান্ডি পৌছান। এলাহাবাদ থেকে ডান্ডি প্রায় ২৪১ মাইল। সে সময় ব্রিটিশরাজ সেই অপমানের বদলা নিতে ৬০,০০০ ভারতীয়কে গ্রেপ্তার করে।
হাঁটা নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। গান্ধী জীবনে এত হেঁটেছেন যে তাতে পুরো পৃথিবী দুইবার চক্কর দেয়া সম্ভব। অর্থাৎ দিনে প্রায় ১৮ কিলোমিটার করে হাঁটতেন তিনি।
গান্ধী তার জীবদ্দশায় দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতে সব মিলিয়ে ১৩ বার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় সাজার আদেশ পেয়েছিলেন ১৯২২ সালে Young India পত্রিকায় ব্রিটিশ বিরোধী জ্বালাময়ী আর্টিকেল লেখার জন্য তাকে ৬ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয় কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ১৯২৪ সালেই মুক্তি দেয়া হয়।
গান্ধী ছিলেন পুরস্কারের ঊর্ধ্বের মানুষ। যাকে নোবেল কমিটি ৫ বার নোবেল মনোনয়ন দিয়েছিল। ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯ এবং ১৯৪৭ সালে মনোনয়ন দিলেও ১৯৪৮ সালে শান্তিতে নোবেল গান্ধীরই পাবার কথা ছিল। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি আততায়ীর গুলিতে মৃত্যু হওয়ায় গান্ধীকে পুরস্কার দিয়ে খাটো করা যায়নি।
গান্ধীর শেষকৃত্যে ১০ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছিল যা প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ হয়েছিল।
মহাত্মা গান্ধী ১৮৬৯ সালের আজকের দিনে (২ অক্টোবর) গুজরাটে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment