বিশেষ প্রতিনিধি : ৫, মে ২০২১। যুবরাজ মেহতা হেড – কর্পোরেট ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশনস, লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো বলেন, উৎকর্ষ হল কর্পোরেটের স্বাক্ষর। এর ছাপ আমাদের তৈরি প্রোডাক্টে থাকে, আমাদের করা সমস্ত প্রকল্পে থাকে এবং আমরা যেসব পরিষেবা দিই তাতেও থাকে। শুধু আমাদের প্রোডাক্ট আর পরিষেবায় নয়, আমরা আমাদের ক্রেতাদের সাথে যে ব্যবহার করি, যেভাবে আমাদের সমস্ত দায়বদ্ধতা পূরণ করি এবং সবসময় কিছুটা বাড়তি উদ্যোগ নেওয়ার যে ইচ্ছা আমাদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় তাতেও উৎকর্ষের ছাপ থাকে।
এসব কোথা থেকে আরম্ভ হল? কোম্পানি সংস্কৃতির মত সংজ্ঞার অতীত একটা জিনিসের উৎস চিহ্নিত করা সহজ নয়। তবে আমাদের ইতিহাসের পাতা উল্টে পিছন দিকে গেলে আপনি কিছু আচরণগত ছক পাবেন, কঠিন মুহূর্তে নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত দেখতে পাবেন এবং কিছু কোম্পানিগত মন্তব্য খুঁজে পাবেন যা জটিল ব্যাপারগুলোতে আমাদের অবস্থান ঠিক করেছিল। এইসব এক করলে যা পাওয়া যায় তা আমাদের গোষ্ঠীগত চরিত্রের কাছাকাছি একটা জিনিস। এটাই সংস্কৃতি।
চলুন সেই সময়ে ফিরে যাওয়া যাক যখন আমাদের কোম্পানির কাজের বেশিরভাগটাই ছিল ডেয়ারি আর কেমিক্যাল প্ল্যান্টের যন্ত্রপাতির ব্যবসা করা। অবশ্যই আমরা একা ছিলাম না। আমাদের প্রতিযোগী বিদেশী বড় কোম্পানিগুলোর প্রোডাক্টও বিক্রি করত, কিন্তু একবার ডিল হয়ে গেলে ক্রেতাদের নিজ দায়িত্বে ছেড়ে দিত, তারা নতুন ব্যবসা থেকে কী করে আরো বেশি লাভ করা যায় তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। হল্ক-লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো একটু অন্য রাস্তা নিয়েছিল। প্রোডাক্ট বিক্রি করা হয়ে গেলে পার্টনাররা নিয়মিত ব্যবধানে দেখতে যেত প্রোডাক্ট প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করছে কিনা এবং আরো কিছু করার আছে কিনা। এটা সামান্য ব্যাপার, কিন্তু এই আচরণ লোকের চোখ এড়ায়নি এবং শীঘ্রই পার্টনারশিপ ভারতীয় শিল্পক্ষেত্রে নাম করে ফেলল। তখন আমাদের স্লোগান ছিল ‘পরিষেবাতেই সাফল্য’ (In Service lies Success)। খুব কম কোম্পানিই তাদের ট্যাগলাইন আমাদের মত অক্ষরে অক্ষরে পালন করত।
মানুষের দ্বারা চালিত
মানুষ হল সংস্কৃতির ইঞ্জিন। একটা সংগঠনের ব্যবস্থাগুলো এবং অন্য সবকিছু চালায় যে জলজ্যান্ত হৃদপিণ্ড, সেটাই হল মানুষ। বোধহয় হল্ক-লার্সেন সেটাই বুঝিয়েছিলেন যখন তাঁর সবচেয়ে স্মরণীয় উক্তিগুলোর একটা করেছিলেন: ‘মেশিনারি থাকতে হবে, ঘরবাড়িও থাকতে হবে। কিন্তু মানুষ না থাকলে এসব কিছুই নয়। মানুষই আমাদের একমাত্র সত্যিকারের সম্পদ।’ শুধু কর্মক্ষমতা নয়, গুণমান বজায় রাখার প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতাও ম্যানুয়াল থেকে মানসিকতায় আনা দরকার ছিল, হ্যান্ডবুক থেকে মনে আনার প্রয়োজন ছিল। এই পরিবর্তন ঘটানো মোটেই সহজ নয়, কিন্তু অবশ্য প্রয়োজনীয়। আমরা একেবারে শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলাম যে ভাল মানসিকতার লোককে নিয়োগ করাই যথেষ্ট নয়। প্রশিক্ষণের সমস্ত স্তরে দায়িত্ববোধ বাঁচিয়ে রাখা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মুক্ত মন
কোন সংস্কৃতির সবটাই ঘরে তৈরি হয় না। বেশ তাড়াতাড়িই আমরা জানলা খুলে রাখার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলাম, যাতে অন্য কর্পোরেট সংস্কৃতির ভাল জিনিসগুলো আমরা নিতে পারি। যেসব কোম্পানির সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছিল তাদের দ্বারা আমরা বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাবিত হয়েছিলাম। তর্কসাপেক্ষ হলেও সম্ভবত আমাদের বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে সবচেয়ে বড় শিক্ষা পেয়েছিলাম এক শ্রদ্ধেয় ট্র্যাক্টর নির্মাতার কাছ থেকে। ১৯৪৫ সালে এল অ্যান্ড টি বিশ্ববিখ্যাত ক্যাটারপিলার ট্র্যাক্টরের ডিলারশিপ পায়। ফলে কোম্পানির বিস্তার বাড়ে, প্রক্রিয়া এবং প্রথাগুলো আরো শক্তিশালী হয় আর কাস্টমার ওরিয়েন্টেশন আরো জোরদার হয়।
ব্যবসা সম্বন্ধে আমাদের মনোভাব এবং আচরণের ভিত্তি ছিল দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির উপর জোর। চটজলদি টাকা কামানো, রাতারাতি বড়লোক হওয়া কোনদিনই আমাদের হিসাবের মধ্যে ছিল বলে মনে হয় না। আমাদের ক্রেতারাও বুঝেছিলেন যে তাঁরা এক দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। কোম্পানির ভিতরে একটা কথা চালু হয়েছিল: “সুখী ক্রেতা আর সুখী বিক্রেতা ছাড়া কারোর মধ্যে কোন ডিল করা চলবে না। আর ক্রেতার সুখ অবিরাম হতে হবে, যেন বিক্রির পরে ভাল পরিষেবা পাওয়ার বিশ্বাস তাঁর থাকে।”
‘চললেই হল’ মনোভাব চলতে না দেওয়া
ভারতে শিল্পায়নের প্রথম কয়েক বছরে অনেক কোম্পানির কাছে গুণমান ছিল তা-ই যা বাজার মেনে নেবে। কিন্তু এল অ্যান্ড টি ওভাবে ভাবেনি। হ্যান্সেন একজন বাতিকগ্রস্ত মানুষ ছিলেন এবং তাঁর বাতিক ছিল গুণমান। মানুষ যা যা করে সবকিছুর গুণমান নিয়েই তিনি খুঁতখুঁত করতেন। তাঁর অফিসের বাইরের ফুলের জমি নিয়ে যেমন, তিনি আর তাঁর দল মিলে যে প্রোডাক্ট বানাবেন তা নিয়েও তেমনি। কারিগররা যখন স্টার্টারের প্রথম দিককার প্রোটোটাইপগুলো নিয়ে তাঁর কাছে যেতেন, তিনি মাথা নেড়ে বলতেন “চলবে না। এটা ফেলে দিয়ে আরেকটা তৈরি করুন।” অভ্যাসবশত নিজেদের প্রয়াসের দিকে তাকিয়ে কারিগররা প্রতিবাদ করতেন, বলতেন ভারতের আমাদের যা অবস্থা তাতে এর চেয়ে ভাল কিছু করা সম্ভব নয়। হ্যান্সেন স্রেফ ড্যানিশ মডেলের উল্লেখ করে রেগে বলতেন: “যদি ডেনমার্কে এটা করা যায়, ভারতেও করা যাবে।” কারিগররা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, চিৎকার চেঁচামেচি করে আবার চেষ্টা করতেন, তারপর আবার… যতক্ষণ না ঐ অনড় ডেন সাহেবের গুণমানের সোনার মানদন্ড ছোঁয়া যেত। গুনার হ্যান্সেন হয়ত উপলব্ধি করতেন না তিনি যা করছেন তার ফলাফল কী, কিন্তু তিনি এল অ্যান্ড টি-র সংস্কৃতিতে একটা জরুরি উপাদান যোগ করছিলেন।
গুনার হ্যান্সেন যাদের ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন এবং এল অ্যান্ড টি-তে নিয়োগ করেছিলেন তাদের মধ্যে একজন হলেন আমাদের বর্তমান গ্রুপ চেয়ারম্যান এ এম নায়েক। তিনি বহুকাল ধরে উৎকর্ষের পূজারী। কোম্পানির দায়িত্ব নেওয়ার পরের দশকগুলোতে শ্রী নায়েক পুরো সংগঠনের মধ্যে এই উপলব্ধি ঢুকিয়ে দিয়েছেন যে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা পেতে হলে গুণমান রক্ষা করা আবশ্যিক। আমাদের রাজস্বের মধ্যে আন্তর্জাতিক ব্যবসার অংশটা দেখলেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়।
ইচ্ছাশক্তি আর দক্ষতা
গুণমান রক্ষা করতে হলেই দক্ষতায় বিনিয়োগ করতে হবে। ‘স্কিল ইন্ডিয়া’ কথাটা কিছুদিন হল জনপ্রিয় হয়েছে। এটা চালু হওয়ার সাত দশক আগে এল অ্যান্ড টি তার ফোকাস প্রশিক্ষণের দিকে ঘোরায়। ১৯৫১ সালে এল অ্যান্ড টি কারিগর এবং দক্ষ শ্রমিকদের জন্য তার প্রথম ট্রেনিং স্কুল তৈরি করে। শ্রমিকদের জন্য তৈরি ড্যানিশ প্রশিক্ষণ প্রকল্পের উপর ভিত্তি করে বানানো এই চার বছরের কোর্সে যারা ভর্তি হত তারা বিশেষজ্ঞের প্রশিক্ষণ এবং স্টাইপেন্ড পেত। এতে সমাজও লাভবান হত, কারণ একটা দক্ষতা অর্জন করলে একটা জীবন বদলে যায়।
শেখার দায়বদ্ধতা এত বছর ধরে আরো জোরালো হয়েছে এবং নতুন ও নানাবিধ চেহারা নিয়েছে। লক্ষ্য করে দেখুন নানারকমের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কতগুলো প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। সবকটাই ভালকে আরো ভাল করার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। মুম্বাইয়ের কাছে লোনাভলায় আছে ডেভেলপমেন্ট অ্যাকাডেমি, ভদোদরায় আছে একটা প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট, সেফটি ইনোভেশন স্কুল আছে হাজিরা আর কাঞ্চিপুরমে। সবচেয়ে সাম্প্রতিক হল এক অনন্য স্কিল ট্রেনার্স অ্যাকাডেমি, যা তৈরি করা হয়েছে মাঢ, মুম্বাইতে। এটা ‘স্কিল ইন্ডিয়া’ উদ্যোগে এল অ্যান্ড টি-র অবদান।
পরিবর্তনশীল লক্ষ্য
আমাদের ইতিহাস আর আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলার এক অনিবার্য বিপদ হল আত্মসন্তুষ্টি এসে যাওয়ার সম্ভাবনা। সেটা ঝুঁকিপূর্ণ। ইতিহাসে এমন বহু কোম্পানির দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যারা নিজেদের সাফল্যকে স্বতঃসিদ্ধ বলে ভেবে নেওয়ার ভুল করেছিল। বেশিদিন নিজেদের অতীত সাফল্যে খুশি হয়ে বসে থাকলে আপনার প্রতিযোগী এগিয়ে যাবে আর আপনি শুধু তাকিয়ে দেখবেন। আমরা আমাদের পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ করে চলেছি এবং নিশ্চিত করছি যে আমাদের প্রযুক্তিগত ভিত্তি যেন আমাদের শিল্পক্ষেত্রের সেরাদের সমান থাকে। অন্যান্য উঁচু র্যাঙ্কের কোম্পানিগুলোর সাথে সাথে আমরাও ডিজিটাল যুগের সূচনা দেখতে পাচ্ছি এবং তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছি। আমাদের লক্ষ্য পুরনো এবং নতুনের সমন্বয় ঘটিয়ে, ইট পাথরের সঙ্গে ডিজিটাল প্রযুক্তি যোগ করে নিজেদের গুণমান উন্নত করা এবং গতি বাড়ানো। উৎকর্ষ মানে হল অবিরাম কাজ।
সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক নির্মাণ প্রকল্পের কথাই দেখুন, অর্থাৎ ITER প্রোজেক্টের জন্য ক্রায়োস্ট্যাট নির্মাণ। এর লক্ষ্য পারমাণবিক ফিউশনের মাধ্যমে পৃথিবীতেই সূর্য তৈরি করা এবং সূর্য যেভাবে শক্তি উৎপাদন করে সেইভাবে শক্তি উৎপাদন করা। এই বিশ্বজোড়া প্রকল্পে বহু দেশের বহু কোম্পানি যুক্ত। এল অ্যান্ড টি ঐ ২৫ বিলিয়ন ডলারের রিঅ্যাক্টরের কেন্দ্রটা তৈরি করার বরাত পেয়েছে। ক্রায়োস্ট্যাট এমন একটা ভেসেল যার তুলনায় অতীতের সব ভেসেলই নেহাত বামন। মানবেতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে বড় হাই-ভ্যাকুয়াম প্রেশার ভেসেল হল ক্রায়োস্ট্যাট।
সঙ্কল্পের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম
কখনো কখনো যে শব্দটা উচ্চারণ করা সবচেয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় সেটা হল ‘না’। কিন্তু যদি উৎকর্ষ আপনার উদ্দেশ্য হয় তাহলে ঘনঘন এবং জোরের সঙ্গে ‘না’ বলতে হবে। বাজে কাজে ‘না’ বলতে হবে, বিশৃঙ্খল পরিকল্পনায় ‘না’ বলতে হবে; অল্পে খুশি হওয়ায় ‘না’ বলতে হবে; চোখে পড়বে না বলে যেটা ফাঁকি দিয়ে করা হচ্ছে তাতে ‘না’ বলতে হবে। এসব করার জন্যে শাস্তিভোগ করতেও হবে। এতকিছু করার কি সত্যিই কোন মানে হয় যখন ক্রেতার হয়ত চোখেই পড়বে না? অন্যভাবে বললে ‘উৎকর্ষ অনেকখানি পরিশ্রম দাবি করে। কেন আমরা অতটা করব?’ এর একটাই উত্তর হয়:
করব, কারণ সেটাই এল অ্যান্ড টি-র ধারা।
Be First to Comment