“আমি বাংলায় গান গাই
আমি বাংলার গান গাই
আমি আমার আমিকে চিরদিন
এই বাংলায় খুঁজে পাই ৷”
ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ২১, ফেব্রুয়ারি, ২০২২। একুশ আমার অহংকার , বাংলা আমার প্রাণ৷
এ ভাষাতেই কথা বলি , এ ভাষাতেই স্বপ্ন বুনি
ইউনেসকো “বাংলাকে পৃথিবীর মধুরতম ” ভাষা নির্বাচিত করেছে ৷ দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান দিয়েছে স্পেনীয় ও ডাচকে ৷ আমি বাঙালি হিসাবে গর্ববোধ করি৷ কারন, বাংলা স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণের ধ্বনি শোনা ও উচ্চারনে একরকম ৷ অক্ষর চিনলেই শুদ্ধভাবে পড়া যায় ৷ আমাদের হরফ বিভিন্নস্থানে বদলায় না ৷ হাতের লেখার বর্ণ আলাদা নয় ৷ বৈজ্ঞানিক ভাবে সুবিন্যস্ত বলে উচ্চারণের ক্ষেত্রে যে ধ্বনির পর যে ধ্বনি আসা উচিত আসে ৷ মুখের উচ্চারনের সঙ্গে লেখা মিলে যায় ৷তাই , একুশের প্রভাতে বলি –
” একুশ হলো রবীন্দ্রনাথ / সুকান্ত নজরুল /
একুশ হলো জীবনানন্দ / এক বৃন্তের ফুল ৷/
একুশ হলো সালাম রফিক / বরকত রহমান৷/
একুশ হলো রক্ত ধারায় / মা ভৈ বলা স্নান ৷
” আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ” ৷ আমার মাতৃভাষা বাংলা সহ বিশ্বের সব ভাষাকে শ্রদ্ধা জানানোর দিন ৷ পাকিস্তানের ৫৪% মানুষ বাঙালি হলেও সেখানে উর্দ্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব করা হয় ৷ এর বিরুদ্ধে আবুল কাসেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিসের ব্যানারে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ গর্জে ওঠে ৷ তবু , সেদেশের তৎকালীন সরকার মুদ্রা , ডাকটিকিট থেকে বাংলা বাদ দেয় ৷ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী তোলেন ৷
এই প্রস্তাবকে সর্মথন করেন প্রেমহরি বর্মা , ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ৷ এতেও টনক না নড়ায় শুরু হয় আন্দোলন ৷ যার পরিণতি একুশে ফেব্রুয়ারি ৷ ১৯৫৪ সালের ৭মে বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় ৷তাই ,শুধু ভাষা , সংস্কৃতি রক্ষা নয় হয়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীকার আন্দোলন৷ আজকের “একুশে ফেব্রুয়ারি ” , ১৯৫২র এই রক্ত ঝরানো দিনটি এখন সারা বিশ্বে সমাদৃত ৷
গাজী উল হক এদিনে প্রথম গান লিখেছিলেন ,
“ভুলবো না ভুলবো না এ একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবোনা ” না বাঙালি ভোলে নি কারন কবেই অতুল প্রসাদ সেন লিখে গেছেন , ” আ মরি বাংলা ভাষা / মোদের গরব , মোদের আশা ” ৷অষ্টাদশ শতাব্দীর কাব্য “নূরনামা ” তে আবদুল হাকিম মাতৃভাষা বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন , “যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী ৷/ সে সবার কিবা রীতি নির্ণয় না জানি ” ৷
বাঙালি তার উত্তরাধিকার ৷ তাই দেখি মানভূমের বাঙালিরা বাংলার দাবীতে ” পুরুলিয়া ” ছিনিয়ে নিয়েছে৷
১৯শে মে ১৯৬১কাছাড়ে বাংলা ভাষার নায্য দাবীতে কমলা ভট্টাচার্যের মত মেয়ে সহ ১১ জন
আত্মবলি দিয়েছেন ৷ বরাক উপত্যকা বাঙালিরা তা প্রমাণ করে ৷পাকিস্তানে সংখ্যাগুরুর ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার দাবীতে বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আবদুস সালাম , রফিকউদ্দিন আহমেদ , আবুল বরকত , আবদুল জব্বারের মত শহীদদের রক্তদানের পরিণতি আজকের “বাংলাদেশ ” , বাংলা ভাষার দেশ ! বরকত আমাদের মুর্শিদাবাদের সালারের বাবলা গ্রামের সন্তান ৷ “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি , আমি কি ভুলিতে পারি ” আবদুল গফফর চৌধুরির লেখা আলতাফ মামুদের সুরারোপিত গানটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় গান হিসাবে স্থান করে নিয়েছে ৷ জহির রায়হান ” জীবন থেকে নেওয়া ” ছবির মাধ্যমে আরো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ৷একুশের প্রথম কবিতা ছিল মাহবুবুল আলম চৌধুরির ” কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি ” আজ সার্থক হয়েছে ইউনেসকো কানাডায় বসবাসকারী দুই বাংলাদেশী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালামের প্রচেষ্টায় বিভিন দেশের একদল মাতৃভাষা প্রেমিকদের সংগঠন ” Mother language of the world ” এর দাবী মেনে ১৯৯৯ সালে এই দিনটিকে ” আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসের ” স্বীকৃতি দিয়েছেন ৷
SIL international র মতে পৃথিবীতে ৬৯১২ টি ভাষা প্রচলিত ৷ আমাদের ভারতে প্রচলিত ১৬৫২ টি ভাষা ৷ যার অনেকগুলি করে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে ৷ যত ছোট ভাষাই হোক লিপি থাকুক না থাকুক নিজস্ব কৃষ্টি ও লোককথার ধারক ৷ যা তার নিজস্বতা ৷ উচিত প্রতিটি মানুষের ভাষাকে সম্মান করা ৷ তাই মাত্র তিন লক্ষ জনসংখ্যার ” বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিরাও ” নিজের ভাষার দাবিতে আন্দোলন করেছেন ৷
পৃথক তেলেগু রাজ্যের দাবিতে চেন্নাইয়ের মালয়াপুরের নিজ বাড়ীতে গান্ধীবাদী
নেতা রামুলু ৫৮ দিন অনশন করে মৃত্যু বরন করেন৷ তাঁর মৃত্যু তেলেগু ভাষীদের হিংসাত্মক করে তুললে নিরাপত্তা রক্ষীদের গুলিতে ৭ জনের মৃত্যু হয় ৷ অবশেষে তৈরী হয় পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য ৷ বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন হিব্রু ভাষাকে ইজরাইল পুনর্জীবিত করেছে ৷ কিন্তু , নিয়মিত পৃথিবী থেকে অসংখ্য ভাষার মৃত্যু হচ্ছে ৷ ২০১০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী শেষ কথা বলা মানুষটির মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডের সুপ্রাচীন কর্নিশ ভাষা হারিয়ে গেছে ৷ নাইজেরিয়ার এনজেরেপ ভাষায় এখন মাত্র ৪ জন কথা বলেন ৷ একটা ভাষার মৃত্যু শুধু ভাষা নয় একটি সংস্কৃতি , একটি ইতিহাসের শেষ ৷ ভারতে এখন ২২ টি প্রধান ভাষা র সঙ্গে সাড়ে উনিশ হাজার কথ্যভাষা প্রচলিত রয়েছে ৷ কথ্য উপভাষা গুলিকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে ৷ তাই ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ভাষা দিবস পালনের ঘোষনা দেয় ৷পৃথিবীর দশটি বৃহৎ ভাষার মধ্যে কারো মতে চতুর্থ কোন মতে ষষ্ঠ বৃহত্তম আমাদের বাংলা ভাষা৷ যা ৩০ কোটি মানুষের মুখের ভাষা৷ বাংলাদেশের এই রাষ্ট্রভাষাকে আফ্রিকার দেশ ” সিয়েরা লিওনও ”
অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়েছে ৷ পশ্চিমবঙ্গ
ও ত্রিপুরার প্রধান রাজ্যভাষা ” বাংলা ” ৷২০১৯ সিলের থিম ” উন্নয়ন , শান্তি ও সম্প্রীতি গড়তে ভাষার ভূমিকা ” ৷১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেও গতবার থেকে ভাষা শহীদদের স্মরণ করা হচ্ছে ৷ যে ভাষায় লেখা হয়েছে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ” জনগনমন”৷ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী মানুষ বাংলাতে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে থাকেন। আমরা যেন সেই পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ও সুমিষ্ট “বাংলা ভাষাকে ” না অবহেলা করি ৷
UNESCO বাংলাকে পৃথিবীর “মধুরতম ভাষা ” ( Sweetest
language in the world) অভিধা দিয়েছে ৷ অক্ষর চিনলেই শুদ্ধভাবে এ ভাষা পড়া যায় ৷যা ইংরেজির মত পাশ্চাত্ত্যের বা আরবী ও আফ্রিকীয় কোন ভাষায় যায় না ৷ হিন্দীর মত লিঙ্গভেদে বদলায় না ৷ শৃখংলতা থাকায় অন্যভাষার শব্দ লিখতে হোঁচট খেতে হয় না ৷আমাদের হাতের লেখা বড় , ছোট কিংবা হাতের লেখায় বদলায় না ৷ বৈজ্ঞানিক ভাবে সুবিন্যস্ত বলে উচ্চারনের ক্ষেত্রে যে ধ্বনির পর যে ধ্বনি আসা উচিত আসে ৷তাই , “একুশ আমার অহংকার , বাংলা আমার প্রাণ ৷ / এ ভাষাতেই কথা বলি , এ ভাষাতেই স্বপ্ন বুনি “৷ আজ তাই বলি ,” একুশ হলো রবীন্দ্রনাথ / সুকান্ত নজরুল / একুশ হলো জীবনানন্দ / এক বৃন্তের ফুল ৷/ একুশ হলো সালাম রফিক / বরকত রহমান ৷/ একুশ হলো রক্ত ধারায় / মা ভৈ বলা স্নান “৷মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ যার বিকল্প হয় না ৷ তাই মাইকেল ফিরে এসেছিলেন ৷ আমার শ্রদ্ধেয় আসাদ চৌধুরীর কলমে তাই বলি , ” ফাগুন এলেই একটি পাখি ডাকে / থেকে থেকেই ডাকে / তাকে তোমরা কোকিল বলবে ? বলো ৷ আমি যে তার নাম রেখেছি আশা / নাম দিয়েছি ভাষা ,” ৷
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী মানুষ যে ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত গায় সেই ভাষা আমার মাতৃভাষা ! আমি ধন্য! আমি একজন গর্বিত বাঙালি ৷
Be First to Comment