সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : কলকাতা, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। তাপমাত্রা মাইনাস সাত ডিগ্রি। এ টি এম কিয়ক্স বন্ধ। হাতে টাকা নেই। পানীয় জল সরবরাহ বন্ধ। প্রায় ৪৮ ঘন্টা হতে চললো মাটির নিচে বাঙ্কারে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে প্রহর গুনছে প্রবাসী ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা। এটাই এই মুহূর্তের ছবি রুশ হানায় আক্রান্ত ইউক্রেনে ভারতীয়দের অবস্থা। ভারতীয় নাগরিকদের এই অবস্থার জন্য দায়ী কি রুশ প্রধান পুতিন ? নাকি ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি? সঠিক উত্তর দিতে পারেন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আমার মত পাতি প্রতিবেদকের কিন্তু অন্য ধারণা। ভারতের বিদেশ মন্ত্রক ও ‘র’ বিভাগ একটু দূরদর্শিতা দেখিয়ে যদি যুদ্ধের আগাম খবর জানতে পারতো, তাহলে বিদেশে পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রী আর এদেশে থাকা তাঁদের অভিভাবকদের উৎকণ্ঠায় অহেতুক দিন কাটাতে হতো না। রাশিয়া ইউক্রেন অধিকার যে আজ নয়, কাল করবে তা বোঝা গিয়েছিল ২০১৪ সালেই। যখন রুশপন্থী ইউক্রেন সরকারের পতন ঘটে। অথচ আমরা ইউক্রেনে পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার কথা কয়েকদিন আগেও ভেবে দেখলাম না। ২৭জানুয়ারি থেকে কিন্তু একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছিল ইউক্রেনে রুশ হানা শুধু সময়েরই অপেক্ষা।
পুতিন বাইডেন বরফ যুদ্ধ প্রথম থেকেই। ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছি, আমেরিকার একমাত্র প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রুশপ্রধানের গুণকীর্তন করেছেন গলা ফাটিয়ে। তেমনই বৈদেশিক নীতি নিয়ে নিজের দেশের প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করছেন। যা কখনও আগে হয়নি। সোভিয়েত থেকে মুক্ত হয়ে ইউক্রেন ২০০৮-০৯সালে প্রবল আর্থিক সংকট কাটিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। চেষ্টা করে গেছে ন্যাটো জোটে যোগ দিতে। এখানেই রুশ প্রধান পুতিনের আপত্তি। কেননা আমেরিকা, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সহযোগিতায় ইউক্রেন যদি ন্যাটো ভুক্তি হয়, তাহলে রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশের বর্ডারে ন্যাটো জোটের সেনা মোতায়েন হবে। সেটা রাশিয়া চায় না। ফলে উপায়,ক্রিমিয়ার মতোই ইউক্রেন দখল। পুতিনের স্বপ্ন, আগের সেই বৃহত্তর সোভিয়েত গড়ে তোলা।
তাই বেশ কিছুদিন ধরেই ইউক্রেন প্রশাসনের সঙ্গে রুশ প্রশাসনের বাক যুদ্ধের ঠান্ডা লড়াই চলছিল।গত ২৭জানুয়ারি স্পষ্ট হয়ে যায় কিছুদিনের মধ্যেই রুশ ইউক্রেন সংঘর্ষ শুরু হতে চলেছে। ন্যাটো ভুক্ত দেশগুলিও বুঝতে শুরু করে দিয়েছিল আমেরিকার চোখ রাঙানিকে রাশিয়া পাত্তা দেবে না। ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের কি আগেই সাবধান হওয়া উচিত ছিল না? দেশের যেসব নাগরিক পেশাগত কারণে ইউক্রেনে আছেন,বা যেসব ভারতীয় ছাত্রছাত্রী ইউক্রেনে পড়াশুনো করতে গেছেন, তাঁদের কি যুদ্ধ শুরুর প্রাক মুহূর্তেই দেশে ফিরিয়ে আনা উচিত ছিল না? সবচেয়ে বড় কথা, ২০১৪সাল থেকে যে পরিস্থিতি তৈরি হতে শুরু করে সেখানে গত জানুয়ারি মাসের ২৮তারিখে যখন বোঝা যায় যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে, প্রবাসী ভারতীয়দের ইউক্রেন থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা তখনই উচিত ছিল। সেটাই হতো দূরদর্শিতা।
সর্বশেষ খবর, ভারতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে মাত্র চার হাজার ভারতীয়কে।যুদ্ধ পরিস্থিতি এমনই ঘোরালো হয়ে উঠেছে যে ইউক্রেনে এয়ার বেস বন্ধ।ফলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার ৪৮ ঘন্টা কাটতে চললো এখনও জীবন হাতে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করছেন প্রায় ২০হাজার ভারতীয়। গতকাল ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে,ইউক্রেনে আটক অসহায় ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তাই এখন দেশের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । দেশের বিদেশ সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন,পোল্যান্ড,হাঙ্গেরি,
স্লোভাকিয়া ও রোমানিয়ার দূতাবাস থেকে ইউক্রেন সীমান্তে ভারতীয় প্রতিনিধি দল পাঠানো হচ্ছে।বাংলায় একটা প্রবাদ আছে,চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘ র ‘ এর উচিত ছিল, রুশ সেনা আগ্রাসনের খবর আঁচ করে ভারতীয় নাগরিকদের আগেই দেশে নিরাপদে ফিরিয়ে আনা।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী মোদী পুতিনের সঙ্গে কথা বলছেন। তিনি নাকি পরামর্শ দিয়েছেন,কূটনৈতিক আলোচনার মধ্যে সমস্যার সমাধান করতে।পাশাপাশি ইউক্রেনে আটকে পড়া ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পুতিন জবাবে কি বলেছেন তা জানা যায়নি। তবে একটা কথা স্বাভাবিক যে, পুতিনের যুদ্ধ ঘোষণা ভারত যে পছন্দ করেনি তেমন কিছু মনোভাব মোদীজি ব্যক্ত করেননি। নেহাতই নিরীহ আর্জি জানিয়েছে ভারত। ইতিমধ্যে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ইগর পোলিখা মোদীজির হস্তক্ষেপ চেয়েছেন । দেশের কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, ভারত এর ফলে বেশ চাপে পড়েছে। বাংলাদেশে একসময়ে কর্মরত বঙ্গতনয় রাষ্ট্রদূত দেব মুখোপাধ্যায় বলেছেন, মোদী সরকারের পক্ষে মধ্যস্ততা করার কোনো সুযোগ নেই।কেননা গত বিশ বছর ধরে আমেরিকা রাশিয়াকে তাবে রাখতে ৯৬বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি।
আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের ৩০টি দেশ রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে থাকলেও পুতিন গ্রাহ্য করছেন না। মূল কারণ, আমেরিকার জুজু চিন ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার পক্ষে রয়েছে। সঙ্গে আছে সিরিয়া। আবার তাইওয়ান প্রশ্নে রাশিয়া চিনের পক্ষে আছে। এই মুহূর্তে আমেরিকান সেনা লাতভিয়া ও পোল্যান্ডে অবস্থান করলেও রাশিয়া চিন্তিত নয়। পুতিন পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন,তাঁদের এই সামরিক অভিযানে যাঁরা হস্তক্ষেপ করবে,তাঁদের ফল ভুগতে হবে। ইতিমধ্যেই রুশ সেনা ট্যাংক নিয়ে ইউক্রেনের ২৩টি প্রদেশে ঢুকে পড়েছে। এই মুহূর্তে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে রয়েছে রুশ সেনা। আসলে ইউক্রেন প্রধান ভ্লাদিমির জেলেন্সকি ভেবেছিলেন ন্যাটো জোট পাশে থাকবেন। হয়তো মৌখিক আশ্বাসও পেয়েছিলেন।কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আমেরিকাসহ ন্যাটো ভুক্ত দেশগুলির তেমন সাহায্য মেলেনি।
আমেরিকা তেমন কার্যকরী ভূমিকা নিচ্ছে না কেন এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। জেনে রাখা দরকার , সমর শক্তিতে মিডিয়া যতই আমেরিকাকে এগিয়ে রাখুক, রুশ ক্ষমতা সম্পর্কে তেমন প্রচার নেই ।মারাত্বক সব ক্ষেপনাস্ত্র রুশপ্রধান পুতিনের হাতে আছে তা কল্পনার অতীত। এটাও ঠিক, যুদ্ধে লাভ ক্ষতি দুইই থাকে। ন্যাটোর বিরোধিতা করে ইউক্রেন দখলে মস্কো জানে বিপুল আর্থিক অবরোধে পড়তে হবে। কোভিড পরিস্থিতিতে যুদ্ধের খরচও এক বিষম দায়। ইউক্রেন দখল হলেও ধ্বংসপ্রাপ্ত ইউক্রেনকে আবার গড়ে তুলতেও বিরাট খরচ। এত আর্থিক বোঝা স্বীকার করাটাও চাপের। তবু পুতিন যুদ্ধেই নামলেন। হয়তো তাঁর হিসেবে ক্ষতির চেয়ে লাভই বেশি হবে।
কেননা রাশিয়ার বক্তব্য, ইউক্রেন এই মুহূর্তে নাৎসিদের মত রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থীদের কব্জায়।ইউক্রেনের বেশিরভাগ মানুষই চান রুশভুক্তি। আবার আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চল রুশ কব্জায় এলে দখলে আসবে মারিউপোল সমুদ্র বন্দর। এই বন্দর দখলে এলে ঘুরপথে বাণিজ্যের সুবিধে হবে। আবার ইউক্রেনের কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য, এই যুদ্ধের প্ররোচনা যুগিয়েছে ইউরোপের কমিউনিস্ট বিরোধী বিভিন্ন গুপ্তচর সংস্থা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এই যুদ্ধে প্রায় ৫০লক্ষ শরণার্থী তৈরি হবে। সিরিয়ার যুদ্ধ থেকেও যা হবে ভয়াবহ। রাশিয়ায় কি অবস্থা? সেখানেও সাধারণ মানুষ বিশেষ করে সেনা পরিবারের মানুষজন চাইছেন না ইউক্রেনে তাঁদের সন্তানেরা যুদ্ধে যাক। সেখানেও চলছে যুদ্ধ বিরোধী প্রতিবাদ মিছিল, প্রতিবাদ। ঠিক যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার মানুষ চাননি তাঁদের ঘরের ছেলে যুদ্ধ করুক।
ইউক্রেনের পশ্চিম অংশের মানুষ চান ইউরোপের সঙ্গে সখ্যতা।আবার পূর্বের মানুষ চান রাশিয়ার সঙ্গ। এমত অবস্থায় রুশ ইউক্রেন যুদ্ধকে অনেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু বলতে চাইছেন। তবে এই প্রতিবেদক মনে করে না আদৌ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে। আস্ফালন হবে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ হবে না। কেননা আজকের দিনে আমেরিকার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র আছে ৬৮০০টি। সেখানে রাশিয়ার একার আছে ৭০০০অস্ত্র। অতএব ইটটি মারিলে পাটকেলটি খাইতে হইবে। সেই দায় কেউ নেবে না। তবে একটি বিষয় অবশ্যই চিন্তিত করছে বিশ্বের মানুষদের।সেটি হলো ইউক্রেনের পরিত্যক্ত চেরনোবিল পরমাণু কেন্দ্র। খবরে প্রকাশ, রুশ বিমান আক্রমণে চেরনোবিল এর পরিত্যক্ত পরমাণু কেন্দ্রের নিষ্ক্রিয় বস্তু ধ্বংস হয়ে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ ঘটাচ্ছে।ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে মাত্র ১৩০কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত চেরনোবিল পরমাণু কেন্দ্রের এই দূষণ ভবিষ্যতে বিশ্বের কতটা ক্ষতি করবে তা সঠিক অনুমান করা এখনই সম্ভব নয়। আমাদের দেশ এই মুহূর্তে আমেরিকা ও তাঁর ন্যাটোভুক্ত দেশগুলি এবং রাশিয়া থেকে সমদুরত্বে অবস্থান করছে । কতদিন এই অবস্থান ভারত রাখতে পারবে সেটাই এখন দেখার।
তবে সবার আগে ইউক্রেনে আটকে থাকা ভারতীয় যুব ছাত্রদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনা দায়িত্ব।দেরিতে হলেও দ্রুত ইতিবাচক ভূমিকা ভারতকে নিতে হবে।এখনও স্পষ্ট নয়,ভারত কিভাবে নিজের দেশের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনবে। এখন শুধু উৎকণ্ঠায় থাকা ছাড়া উপায় নেই।
ছবি সৌজন্যে – গুগুল।
Be First to Comment